সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যিনি ‘লোটাস কামাল’ নামে অধিক পরিচিত, এখন দুর্নীতির এক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনকালে তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী ও পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বহুদিন ধরেই।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছরের দায়িত্বকালে মাত্র ৭২ দিন অফিস করেছেন তিনি। এ সময় তাঁর ডিমেনশিয়া রয়েছে বলে প্রচার ছিল, কিন্তু অর্থ ও সম্পদের প্রশ্নে স্মৃতিভ্রংশ ছিল না বলেই প্রতীয়মান। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুট, জনশক্তি রপ্তানিতে দুর্নীতি, টেন্ডার জালিয়াতি—সবকিছুতেই তাঁর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করার পেছনে তাঁর বড় ভূমিকা রয়েছে।
বিদেশে গড়ে তুলেছেন সাম্রাজ্য
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সাতটি দেশে রয়েছে লোটাস কামাল ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পদ। দুবাইতেই অন্তত ১৮টি নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে তাঁদের নামে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ইউ-ট্যাক্স জানায়, ২০২২ সালে দুবাইয়ের আবাসন খাতে বাংলাদেশি ৫৩২ জন বিনিয়োগকারী ছিলেন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন লোটাস কামাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাও।
‘অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির অন্যতম মালিক লোটাস কামালের স্ত্রী কাশমেরি কামাল। বাংলাদেশে জনশক্তি রপ্তানির কাজ করলেও বর্তমানে দুবাইতে এই কোম্পানি ছয়টি বড় আবাসন প্রকল্পে কাজ করছে। এসব প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। লোটাস কামাল, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে নাফিসা কামালের নামে দুবাইয়ের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় রয়েছে ১৮টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। সব মিলিয়ে এই সম্পদের বাজারমূল্য বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯৩৭ কোটি।
নাফিসা কামালের বিলাসবহুল উদ্যোগ
নাফিসা কামাল ‘এনকে স্পোর্টস’ নামে একটি স্পোর্টস ইভেন্ট কোম্পানি পরিচালনা করেন, যার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান। কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। এছাড়া তিনি একটি ফ্যাশন হাউস চালান, যার দুবাই ও শারজাহ শহরে ছয়টি শোরুম রয়েছে। নতুন করে তিনি একটি আন্তর্জাতিক মানের কসমেটিকস কোম্পানি চালু করছেন, যার জন্য শারজাহতে জমিও কেনা হয়েছে।
২০২২ কাতার বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে সেখানে ব্যবসায়িক বিনিয়োগ শুরু করেন নাফিসা কামাল। তিনি এখন কাতারে নিবন্ধিত ব্যবসায়ী এবং স্টক এক্সচেঞ্জেও তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে। সৌদি আরবে শপিং মল নির্মাণ এবং দুটি ফুটবল ক্লাবের শেয়ার কেনার জন্যও আবেদন করেছেন তিনি।
দুবাই ঠিকানা ব্যবহার করে লন্ডনে বাড়ি কিনেছেন লোটাস কামাল। সেখানে তাঁর ছোট মেয়ে বাস করেন এবং ব্যবসা পরিচালনা করেন। সুইস ব্যাংকেও তাঁর অর্থ থাকার প্রমাণ মিলেছে, যদিও ব্যাংকটির কঠোর গোপনীয়তার কারণে বিস্তারিত জানা যায়নি।
ভানুয়াতুর ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব কিনেছেন লোটাস কামাল। এ দেশের ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’ কর্মসূচির আওতায় এক লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারে নাগরিকত্ব কেনার মাধ্যমে তিনি এখন ১৩০টি দেশে ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন। এ ধরনের নাগরিকত্ব অনেক বিতর্কিত ধনকুবেরদেরও রয়েছে, কারণ এই দেশের আয়কর ও সম্পদ কর নেই।
দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের মাধ্যমে একটি বড় অংশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিদেশে সরিয়ে নিয়েছেন লোটাস কামাল ও তাঁর পরিবার—এমনটাই উঠে এসেছে বিভিন্ন অনুসন্ধানে। দেশে না থাকলেও তাঁর ‘অদৃশ্য উপস্থিতি’ অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই ধরণের অর্থপাচারকারীরা কি কখনো বিচারযোগ্য হবেন?