সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ের যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে একটি পূর্ণাঙ্গ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা বাধ্যতামূলক। কারণ, এ সমীক্ষার মাধ্যমেই বোঝা যায় প্রকল্পটি কতটা অর্থনৈতিক, সামাজিক বা কারিগরি দিক থেকে টেকসই। অথচ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) যেন সে নিয়মকে থোড়াই কেয়ার করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প (ব্লক-‘বি’ ও ‘সি’)’ নামে একটি বিশাল বাজেটের প্রকল্প প্রস্তাবনা দিয়েছে সংস্থাটি। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু বড় অঙ্কের এই প্রকল্পে কোনো ধরনের সমীক্ষাই করা হয়নি—এমন অভিযোগ উঠেছে। আর এ নিয়েই সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি জানানো হয়েছে।
গত ১৯ জুন অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে প্রথম প্রশ্ন ওঠে। বিশেষ করে অতিরিক্ত ব্যয় এবং সমীক্ষার অনুপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ভৌত অবকাঠামো বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদের ভাষায়, সমীক্ষা ছাড়া এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা মানে হচ্ছে “অন্ধকারে ঢিল ছোড়া”। তার মতে, সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নানা জটিলতা দেখা দেয়, বাড়ে সময় ও খরচ—যা শেষ পর্যন্ত জনসাধারণের অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য ২০ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় রাজউক। ‘এ’ ব্লকের কাজ শেষ হলেও ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লকের কাজ থেমে যায় বিদেশি সহায়তা না আসায়। পরে সেগুলোর জন্য আলাদা করে একটি নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করে রাজউক—যার নাম দেওয়া হয় ‘রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প (ব্লক-‘বি’ ও ‘সি’)’।
এই নতুন প্রকল্পে মোট ৭,৫৪৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এত বিশাল ব্যয়ের প্রকল্পেও সঠিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পিইসি সভায় আরও একটি গুরুতর ইস্যু উঠে আসে—প্রকল্পের ব্যয় অত্যধিক ধরা হয়েছে। শুধু আবাসিক ভবনের নির্মাণ ব্যয়েই প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ৮,২৮০ কোটি টাকা, যা প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ৯০ হাজার টাকা! পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা এই খরচকে “অস্বাভাবিক” ও “অযৌক্তিক” বলে মন্তব্য করেন এবং ব্যয় কমানোর পরামর্শ দেন।
এছাড়া যানবাহন ভাড়া, জ্বালানি খরচ, প্রশিক্ষণ সফর, আসবাবপত্র কেনা, বিজ্ঞাপন ও প্রচার বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়েও আপত্তি তোলা হয়। অনেক ব্যয় খাতে অতিরিক্ত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা সহজেই কর্তনযোগ্য বলে মনে করছে কমিশন।
রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছিল, তবে তা এখনো সংশোধিত ডিপিপিতে যুক্ত হয়নি। পিইসি সভায় প্রকল্পের খরচ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে একটি যাচাই কমিটি গঠনের সুপারিশও করা হয়েছে।
সরকারি অর্থে পরিচালিত একটি বড় প্রকল্পে এমন খামখেয়ালিপনা যে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা বিগত সময়েই দেখা গেছে। রাজউকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যদি নিয়ম ভেঙে ১৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে—তাহলে এর দায় কেবল আর্থিক নয়, নীতিগতও।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাঝে দায়িত্বশীলতার এই ঘাটতি কেবল জনসাধারণের আস্থা নষ্টই করে না, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ও ঘটায়। এখন দেখার বিষয়, কমিশনের আপত্তির পর এই প্রকল্পে আদৌ কোনো গঠনমূলক পরিবর্তন আসে কিনা।

