বগুড়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগে শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হকের নেতৃত্বে এই দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। সম্প্রতি পরিবেশবাদী ও আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এসব অভিযোগ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়।
চিঠিতে দাবি করা হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এই দুই কর্মকর্তা পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে নামমাত্র কাজ করিয়ে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারেই কাজ না করেই প্রকল্পের টাকা তুলে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজেরাই পাউবোর লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে গোপনে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করে কাজ ভাগ করে নিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়, কাজ না করেই তারা বিল উত্তোলন করেছেন, যা একেকটি প্রকল্পে কোটি টাকার অনিয়মে পরিণত হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনডিআর কর্মসূচির আওতায় প্রকাশিত ৭৭টি গ্রুপ টেন্ডারে (যার মোট প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ১২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা) মাত্র ৮-১০ জন নিয়মিত ঠিকাদারকে অল্প কিছু কাজ দেওয়া হয়। বাকি কাজ নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে সম্পন্ন করা হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে। তথ্য মতে, এসব ঠিকাদারদের অনেকেই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ঘনিষ্ঠ। তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলী মিলে লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে কাজ হাতিয়ে নেন এবং সেই কাজও আংশিক কিংবা একেবারেই সম্পন্ন হয়নি বলে অভিযোগ।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ইছামারা ও কামালপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ‘জরুরি কাজ’ দেখিয়ে বারবার একই জায়গায় বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। বাস্তবে এসব কাজ হয় আংশিক হয়েছে, নয়তো একেবারেই হয়নি। এইভাবে বারবার একই প্রকল্পের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়। ২০২৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এলটিএম পদ্ধতিতে প্রকাশিত ২০টি গ্রুপ টেন্ডারের (প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ২ কোটি টাকা) কাজও সম্পূর্ণভাবে শেষ না করেই বিল উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের পেছনেও একই দুই প্রকৌশলীর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, পানি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কবির বিন আনোয়ার, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজুলল করিম সেলিম, সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু ও সাহাদারা মান্নানের সহযোগিতায় ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে টেন্ডার ছাড়াই প্রায় ১০০ কোটি টাকার ‘জরুরি প্রকল্পের’ কাজ অনুমোদন করিয়ে ফেলা হয়।
অভিযোগকারীর দাবি, এসব কাজের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ হলেও সম্পূর্ণ বিল উত্তোলন করা হয়েছে। চিঠিতে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলামের নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ অর্জনের কথাও বলা হয়েছে। বগুড়ার সেউজগাড়ী এলাকায় ৯ কোটি টাকা মূল্যের একটি জমি, সাতানি বাড়ি এলাকায় ১০ তলা ভবনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব সম্পদের বেশির ভাগই তার ও তার স্বজনদের নামে-বেনামে কিনে রাখা হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের দিয়ে করালে প্রকৃত তথ্য বের হবে না। এজন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, বুয়েটের একজন প্রকৌশলী এবং কমার্শিয়াল অডিট প্রতিনিধি নিয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানানো হয়। অভিযোগকারী মনে করেন, নিরপেক্ষ তদন্ত হলে আরও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম প্রকাশ্যে আসবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, “প্রকল্পের টেন্ডারগুলো নির্বাহী প্রকৌশলীর অধীনে হয়। তাই কোনো দরপত্রে আমার সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই।”
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হক বলেন, “প্রকল্পের কাজগুলো মনিটর করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রয়েছেন। একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্সও কাজগুলো পর্যালোচনা করে। কাজগুলো শুধু আমার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় না।” ২০২৪ সালের ২৭ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, প্রকৌশলীরা গোপনে দর সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যাতে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ বজায় থাকে।

