রাজধানী ঢাকা যেন এখন আতঙ্কের শহর। দিন-রাত নির্বিশেষে শহরের বিভিন্ন সড়কে ছিনতাই, দস্যুতা, অপহরণ ও সহিংসতার ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বয়স, পেশা বা শ্রেণিভেদ না করেই অপরাধীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে পথচারীদের ওপর। চলতি বছর এসব অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, বাড়ছে মানুষের উদ্বেগ।
অপরাধের পরিসংখ্যানে আতঙ্ক:
২০২৩ সালে যেখানে ডাকাতির মামলা ছিল ১,২২৭টি, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৪১২-এ—বৃদ্ধি প্রায় ১৫%। একইভাবে আগস্ট ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা হয়েছে ১,১৪৫টি, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০% বেশি। একই সময়ে দেশে হত্যার মামলা বেড়েছে ৬৯%। ২০২৩ সালে যেখানে দৈনিক গড়ে ৮.৩৩ জন খুন হতেন, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে গড় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১১ জনে। ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২,৭৪৪টি—প্রায় প্রতিদিনই গড়ে ১৫টি ঘটনা। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে হয়েছে ১১,০০৮টি, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২২% বেশি। অপহরণ মামলাও ৮৬% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪৮টিতে। শুধু জানুয়ারিতেই ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা ২৪২টি—যা আগের বছরের তুলনায় ৪৮৭% বেশি।
রাজধানীর ভয়ংকর চিত্র:
গুলশান, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, মিরপুর, ধানমন্ডি, বনশ্রী, তেজগাঁও, বাড্ডা—সব এলাকাতেই ছিনতাইকারীরা দিন-রাতে অস্ত্র নিয়ে হামলা করছে। ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বা স্বর্ণ বিক্রেতাদের টার্গেট করে ছিনতাই ও হত্যা বেড়েছে। বনশ্রীর এক ঘটনায় ছিনতাইকারী সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে মালামাল লুট করে—যার ভিডিও ভাইরাল হয়। তবে অনেক ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে গেলে মামলা না নিয়ে জিডি হিসেবে গ্রহণ করার অভিযোগ করছেন। সাহসী ঘটনা ঘটলেও ‘ডাকাতি’ হিসেবে মামলা না রেকর্ড করার ঘটনাও আছে।
অপরাধ বাড়ার কারণ:
-
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থবিরতা: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পুলিশের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময়ে পুলিশ মাত্র ২৫% সক্ষমতায় কাজ করেছে। বিভিন্ন থানায় হামলার ঘটনায় ১৫ পুলিশ নিহত হন।
-
সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপ: বেকারত্ব, তরুণদের হতাশা, মাদকাসক্তি ও আয়-উপার্জনের পথ সংকুচিত হওয়ায় অনেকেই অপরাধে জড়াচ্ছে। ঢাকায় সক্রিয় প্রায় ৫০টি কিশোর গ্যাং অপরাধে জড়িত তরুণদের ব্যবহার করছে।
-
আইনের দুর্বল প্রয়োগ: অপরাধীরা গ্রেফতার হলেও জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রের আশ্রয়ে থেকে তারা বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে অপরাধের ভয় আর শাস্তির ভয় হারিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশের অভিযান ও প্রতিক্রিয়া: ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযানে মাত্র ৮ দিনে ১১,৩১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ডিএমপি, র্যাব ও টহল পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে আসছে। তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই অভিযান কি স্থায়ী সমাধান দিতে পারছে?
নাগরিক উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা: সাধারণ মানুষ এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রাত ৯টার পর একা রাস্তায় চলাফেরাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন অনেকে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে ভয়, নির্জন সড়ক দিয়ে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। রেডিটসহ সামাজিক মাধ্যমে মানুষ বলছেন, প্রতিদিন সকালে তারা ভাবেন—আজও হয়তো কোনো ধর্ষণ বা খুনের খবর শুনতে হবে।

প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ:
- ঢাকার অন্তত ৭০% এলাকায় কার্যকরভাবে সিসিটিভি বসানো প্রয়োজন।
- মোবাইল অ্যাপ ও SOS ফিচার চালু করতে হবে।
- দুর্গম পাড়া ও ফ্লাইওভার মোড়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক উদ্যোগ:
- যুবকদের জন্য কারিগরি শিক্ষা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি ও মাইক্রো-ফাইন্যান্স ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।
- বিট পুলিশিং ও স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে কমিউনিটি পর্যায়ে নজরদারি জোরদার করা।
বিচারিক ও আইনি পদক্ষেপ:
- জামিনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আনতে হবে।
- দ্রুত বিচার আইনের কার্যকর প্রয়োগ জরুরি।
- রাজনীতির প্রভাবমুক্তভাবে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
সচেতনতা ও মিডিয়া ব্যবহার:
- গুজব ও ভীতি ছড়ানো ভিডিও দমনে সরকারকে নজরদারি বাড়াতে হবে।
- তরুণদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রচার প্রয়োজন।
ঢাকা এখন কেবল একটি শহর নয়, বরং নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে নাগরিকেরা রাস্তায় বের হলেই ভয় পায়, সেখানে কেবল অভিযান চালিয়ে কিংবা মামলা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। প্রয়োজন প্রযুক্তি, নীতিনির্ধারণ, বিচার এবং সামাজিক আস্থার সম্মিলিত পদক্ষেপ। রাজধানী নিরাপদ না হলে, দেশের ভবিষ্যৎও নিরাপদ নয়।

