কুমিল্লা নগরীর নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তনের আশা নিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হয় ৯০টি সিসিটিভি ক্যামেরা। এতে ব্যয় হয় দুই কোটিরও বেশি টাকা। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এসব ক্যামেরায় ছিল এআই সাপোর্ট, গাড়ির নম্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করার প্রযুক্তি, মানুষের মুখাবয়ব চিনতে পারা, নাইট ভিশন, ৩৬০ ডিগ্রি ঘূর্ণন এবং ভিডিও রেকর্ডিং সুবিধা।
সিটি করপোরেশনের আশা ছিল—এগুলো অপরাধ দমন, যানজট নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি অবস্থায় তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। নগরবাসীরও ছিল একই প্রত্যাশা।
তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। বেশির ভাগ ক্যামেরাই এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কোথাও লেন্সে জমেছে ধুলা, কোথাও ক্যামেরার মুখ অন্যদিকে ঘুরে গেছে। অনেক জায়গায় তার ছিঁড়ে গেছে বা সংযোগ নষ্ট হয়েছে। ফলে নির্ধারিত এলাকায় কার্যকরভাবে ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না।
ফৌজদারি মোড়, চকবাজার, ইপিজেড ফটক, টমছম ব্রিজ, কান্দিরপাড়সহ অন্তত ৯০টি স্থানে এসব ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্যামেরাগুলো কার্যত অচল হয়ে গেছে—এমনকি সিটি করপোরেশনের মূল ফটকের ক্যামেরাটিও কাজ করছে না।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মালিকানাধীন ‘নাইস পাওয়ার আইটি সলিউশন লিমিটেড’কে। ২০১৮ সালে সরকারি ক্রয়নীতির তোয়াক্কা না করে কোটেশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটি কাজটি পায়।
২০২০ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এরপর নিয়মিত বিল নেওয়া হলেও রক্ষণাবেক্ষণে চরম অবহেলা ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় একে একে ক্যামেরাগুলো বিকল হয়ে পড়ে।
সাধারণ মানুষ বলছেন, ক্যামেরা লাগানো হলেও তা যে কাজ করছে না—তা চোখেই দেখা যায়। কেউ এগুলো দেখাশোনা করে না, অথচ ঠিকাদার নিয়মিত বিল তোলে। নগরের নিরাপত্তা যে এই ক্যামেরাগুলোর ওপর অনেকটা নির্ভর করে, তা অনেকেই স্বীকার করছেন।
কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী এনামুল হক ফারুক বলেন,
“চুরি-ছিনতাই বেড়েছে। অপরাধীদের শনাক্ত করার উপায় ছিল সিসিটিভি ক্যামেরা। এখন সেগুলো কার্যত অচল।”
একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করা তানভীর আলম অভি বলেন,
“নগরে ইভ টিজিং ও ছিনতাই বাড়ছে। এসব ক্যামেরা সচল থাকলে কিছু ঘটনা অন্তত রোধ করা যেত।”
সিটি করপোরেশনের তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ খায়রুল বাশার জানান,
“নতুন করে টেন্ডার দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০টি ক্যামেরা সচল হয়েছে। বাকিগুলো নিয়েও কাজ চলছে।”
তিনি আরও জানান, এসব ক্যামেরায় গাড়ির নম্বর শনাক্ত করা, নাইট ভিশন, ১০০ মিটার পর্যন্ত ভিডিও ধারণ এবং ১০ দিনের ভিডিও সংরক্ষণ সুবিধা রয়েছে।
সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন বলেন,
“আগের ঠিকাদারদের বাদ দিয়ে নতুন লোক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব ক্যামেরা সচল হবে।”
তবে অনেক নাগরিক কর্তৃপক্ষের এসব আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছেন না। দীর্ঘদিনের গাফিলতির কারণে প্রকল্পটি নিয়ে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। তাঁরা বলছেন, শুধুমাত্র প্রযুক্তি বসালেই হবে না—নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, কার্যকর মনিটরিং ও দায়বদ্ধতা ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব।
দুটি বিষয় একসঙ্গে উঠে আসছে—আধুনিক প্রযুক্তির সম্ভাবনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতা। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এই প্রকল্প একটি উদাহরণ হয়ে থাকছে যে, প্রযুক্তি থাকলেই যথেষ্ট নয়—সেটির দেখভাল ও স্বচ্ছতা না থাকলে কোটি টাকার বিনিয়োগও ব্যর্থ হতে পারে।

