টাকা, গাড়ি, বাড়ি আর জমির পাহাড় যেন হয়ে উঠেছিল জান্নাত আরা হেনরির একক সাম্রাজ্য। মাত্র ১৪ বছরে এক সহকারী শিক্ষিকা থেকে তিনি বনে গেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য এবং কথিত হাজার কোটির সম্পদের মালিক। সাধারণ এক শিক্ষক পরিবার থেকে উঠে এসে এখন যাঁর নামে চলছে শত কোটি টাকার মানিলন্ডারিং তদন্ত।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হয়েছিলেন হেনরি। সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাত্র ৬ মাস ২৫ দিন। এরপর জনরোষ ও দুর্নীতির অভিযোগে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। তবে শেষরক্ষা হয়নি। ধরা পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।
হেনরির উত্থান শুরু হয় সিরাজগঞ্জ সদরের সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। স্কুলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন। রাজনীতিতে প্রবেশ করে এক যুগের মধ্যেই হয়ে ওঠেন সম্পদের প্রতীক।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানায়, হেনরির বর্তমান সম্পদের যে চিত্র উদঘাটিত হয়েছে, তা শুধু খণ্ডিত অংশ। এসব সম্পদের উৎস, পরিমাণ ও গতি দেখলে বোঝা যায়, কীভাবে শাসনামলে দুর্নীতির শেকড় গেঁথেছিল ক্ষমতার ভেতর।
দুদক জানায়, হেনরির নামে বর্তমানে ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ২ কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৭৭ টাকা। এর পাশাপাশি রয়েছে ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার মার্কিন ডলারের মানিলন্ডারিংয়ের তথ্য।
শুরুটা ছিল ক্ষুদ্র কিন্তু উত্থানটা বিস্ময়কর
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান জান্নাত আরা হেনরি। তখন তার মাসিক আয় ছিল ১০ হাজার টাকা, নগদ অর্থ সাড়ে ৪ লাখ। একই সময়ে তিনি রিকশায় চড়ে স্কুলে যেতেন।
তবে সেই গল্প আজ অতীত। ১৪ বছর পর তিনি হয়ে ওঠেন ১৬টি গাড়ির মালিক। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, সব গাড়ির নিবন্ধন ঢাকা মেট্রো-১ এবং মিরপুর সার্কেল থেকে নেওয়া। হেনরির ব্যবহৃত গাড়ি ঢাকা মেট্রো-ঘ-২১-৭৩৮৮, যার ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা। তদন্ত কর্মকর্তাদের দাবি, এর প্রকৃত মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা।
তার পরিবারের ব্যবহৃত আরেকটি গাড়ির (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১২-২০৪৯) দাম দেখানো হয়েছে ৬১ লাখ। বাকি ১৪টি গাড়ির দাম ১০ লাখ থেকে ৩২ লাখ টাকার মধ্যে।
সম্পদ বলতে যা বোঝায়, তার পুরোটাই যেন রয়েছে হেনরির দখলে
হেনরির নামে রয়েছে ঢাকাসহ সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও পটুয়াখালিতে ফ্ল্যাট, ভবন ও জমি।
- সিরাজগঞ্জে ৭ তলা ভবন: দলিলমূল্য ২ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা
- সিরাজগঞ্জে ফ্ল্যাট: ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা
- মিরপুরে ২ ফ্ল্যাট: ৫০ লাখ টাকা
- বাহুকা রতনকান্দিতে ২ তলা ভবন: ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা
- ভূতেরদিয়ায় জমি ও ভবন: ৮২ লাখ ১৪ হাজার টাকা এবং ২ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার টাকা
- রূপগঞ্জে দুটি জমি: মোট দলিলমূল্য ৪৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা
- খেপুপাড়ায় জমি: ২.৫১ একর, দলিলমূল্য ১ কোটি ১০ লাখ ৯২ হাজার টাকা
এছাড়াও সিরাজগঞ্জের বাহুকা-রতনকান্দি, পূর্ব মোহনপুর, শিলন্দা, বনবাড়ীয়া, সদানন্দপুর, ভারাঙ্গা ও রায়গঞ্জ এলাকায় একাধিক জমির দলিল পাওয়া গেছে।
সবমিলিয়ে এই জমিগুলোর দলিলমূল্য কয়েক কোটি টাকা হলেও দুদক বলছে, প্রকৃত মূল্য তার চেয়েও বহুগুণ বেশি। অনেক সম্পদের তথ্য আয়কর রিটার্নে দেখানো হয়নি।
রাজনীতির সঙ্গে তদবির বাণিজ্যই ছিল মূল চালিকা শক্তি
২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে গেলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করা হয়। এরপরই শুরু হয় তার আর্থিক উত্থান।
হলমার্ক কেলেঙ্কারির সুবিধাভোগ, ঋণ অনুমোদন, পদোন্নতির তদবিরসহ বিভিন্নভাবে তিনি বিতর্কিত হন। রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল আর্থিক নেটওয়ার্ক।
আইনি জটিলতা ও শেষ পরিণতি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর জান্নাত আরা হেনরি ও তার স্বামী শামীম তালুকদার লাবু আত্মগোপনে চলে যান। তবে ৩০ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার থেকে তারা গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে তারা কারাগারে।
দুদক তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। আদালতে আবেদন করে এসব সম্পদের ওপর রিসিভার নিয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে, যাতে কোনো সম্পদ স্থানান্তর করা না যায়।

