২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ‘জুলাই বিপ্লব’–এর পর থেকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবাদপ্তরে ঘুষের পরিমাণ ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ভূমি অফিস, আদালত, পুলিশ, পাসপোর্ট দপ্তর, স্থানীয় সরকার সংস্থা, বন্দর পরিষেবা, সচিবালয়ের ফাইল ছাড়ানো এবং বিআরটিএ–তে এখন আগের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ নাগরিকরা।
আগে যে কাজের জন্য ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিলেই চলত, এখন সেটির জন্য ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে। ঘুষের এই বেড়ে যাওয়া মাত্রা শুধু হয়রানির সীমা বাড়ায়নি, বরং একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নতুন এক তদবিরচক্র। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া, সুদ মওকুফ কিংবা মামলায় জামিন পেতে এখন মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে কোনো কাজই হয় না। এসব ক্ষেত্রে আগে পরিচিত কিছু মানুষই তদবির করত, কিন্তু এখন নতুন ‘দাপুটে তদবিরবাজ’ ঘুষ আদায়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যারা প্রভাব দেখিয়ে আরও বেশি ঘুষ দাবি করছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এই দুর্নীতির প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের আগে যে কাজের জন্য ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হতো, এখন সেটার জন্য দিতে হচ্ছে ৫ লাখ টাকা।’ একজন ভুক্তভোগী জানান, আগে জমির খতিয়ান সংশোধনের জন্য ১৫ হাজার টাকায় কাজ হয়ে যেত, এখন তার জন্য চাওয়া হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘কিছু নতুন লোক এসেছে যারা সহযোগিতা করার নামে চরম অর্থনৈতিক শোষণ চালাচ্ছে।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিচার বিভাগ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে দুর্নীতি ও ঘুষের উচ্চহার এখনো বহাল আছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে ভূমি, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বিআরটিএর মতো মৌলিক সেবাখাতেও দুর্নীতির মাত্রা ভয়াবহ।
টিআইবির সর্বশেষ গবেষণা বলছে, ২০২৩ সালে দেশে মোট ঘুষের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা সেই সময়ের জাতীয় বাজেটের ১.৪৩ শতাংশ এবং জিডিপির ০.২২ শতাংশ। ঘুষের দিক থেকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত তিনটি খাত হলো ভূমিসেবা ও বিচারিক সেবা (প্রত্যেকটি খাতে ২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা) এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী (২ হাজার ৩৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা)। এছাড়া পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন খাতে ১ হাজার ৩৫০ কোটি, স্থানীয় সরকারে ৮৪০ কোটি, বিদ্যুৎ খাতে ৩০৯ কোটি, স্বাস্থ্য খাতে ২৩৫ কোটি এবং শিক্ষা খাতে ২১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে।
এই চিত্র বলছে, ঘুষ এখন আর বিচ্ছিন্ন কোনো দুর্নীতির দৃষ্টান্ত নয়— বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। দুদকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাঁরা নিয়মিতভাবে এসব অভিযোগ পাচ্ছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোর ভেতরে দুর্নীতি প্রতিরোধের নিজস্ব ব্যবস্থাই এতটা দুর্বল যে, তা কোনোভাবেই ঘুষ সংস্কৃতিকে প্রতিহত করতে পারছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, রাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণের অন্যতম কারণ হলো দুর্নীতি ও ঘুষের দাপট। ‘জুলাই বিপ্লব আমাদের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, কিন্তু এখন শুধু হাত বদল হয়েছে, ব্যবস্থা বদলায়নি। আর ব্যবস্থা বদল না হলে অনিয়ম রয়ে যাবে সেই পুরোনো জায়গাতেই।’
ঘুষের এই লাগামছাড়া রীতি বন্ধ করতে কার্যকর সংস্কার ছাড়া কোনো পথ নেই— এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা। নতুবা রাষ্ট্রীয় সেবার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা হারানোর এই ধারা আরও গভীর হবে এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বাড়বে।

