বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশের বিরুদ্ধে গুম, নির্যাতন, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব ঘটনায় কেউ বরখাস্ত, কেউ পলাতক, আবার কেউ এখনও বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। এসব ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি ও শাস্তির দৃষ্টান্ত নিয়ে।
সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) মো. বখতিয়ার ইসলাম। পিবিআইয়ের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদারসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৩০ মে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় বলা হয়, প্রকৃত আসামি আবু সালেকের স্থানে নিরপরাধ জাহালমকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও জেল হাজতে পাঠান তারা। সেই জাহালম তিন বছর বিনা দোষে কারাভোগ করেন।
পিবিআইয়ের করা তদন্তে এমন ভুলের কোনো সত্যতা না পাওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের অবস্থান থেকে সরেনি। অভিযোগ, মামলার তথ্য-প্রমাণ গোপন করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এ ঘটনায় বখতিয়ার এখন পলাতক। বনজ কুমার উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে রয়েছেন।
এ ধরনের ঘটনায় একাধিকবার পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকা সামনে এসেছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়ারছড়ায় ১৪ বছরের এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। কিশোর বলেছিল, ‘আমারে কয়, তুই স্বীকার কর, তুই খুন করছস। আমি বলছি, আমি খুন করি নাই। তাও কয়, বল, তুই খুন করছস। মার খাইতে খাইতে আমি শেষ।’ ঘটনার তদন্তে পুলিশের নির্যাতনের সত্যতা মেলায় পাঁচ পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করে বিভাগীয় তদন্ত হয়। তবে বিচার এখনো শেষ হয়নি।
- ২০২১ সালে ঢাকার ওয়ারীতে বাসচালক নজরুল ইসলামকে নির্যাতনে হত্যা ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন গোপনের অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত চলছে। তবে অভিযোগ প্রমাণে দীর্ঘসূত্রতায় মামলাগুলোর বিচার ঝুলে আছে।
- এছাড়া সিলেটে ‘রায়হান হত্যা মামলা’য় বরখাস্ত হন এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া। অভিযোগ ওঠে, থানায় ধরে নিয়ে রায়হানকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার পর আকবর ভারতে পালিয়ে যান। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এখনো বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।
- বরিশালে ইউএনওর বাসায় পুলিশের হামলার ঘটনায় তৎকালীন এসপি মো. মারুফ হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও বেশ কয়েকজন আবার দায়িত্বে ফিরেছেন। এ ঘটনায় দায়ীদের বিচারে শাস্তির প্রক্রিয়া ধীরগতি হওয়ায় সমালোচনা হয়।
- ঢাকার গেন্ডারিয়া থানার ওসি রতন শেখের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে ২০২০ সালে। সিসিটিভি ফুটেজে নির্যাতনের প্রমাণ মেলায় তিনি বরখাস্ত হন। যদিও এরপরও তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
- চাঁদাবাজি ও অনিয়মের অভিযোগে ময়মনসিংহের এসপি শাহ আবিদ হোসেনের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে তিন মাসের মধ্যে তিনবার গুলি চালিয়ে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় ওসি এ কে এম মেহেদী হাসানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে এসব ঘটনায় দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের কারও শাস্তি হয়নি বললেই চলে।
- এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, গাইবান্ধায় বিএনপি নেতা মোজাফফর হত্যা, নওগাঁয় কৃষক হত্যা, রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার মতো ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে বিচারের দৃষ্টান্তের অভাব আছে প্রায় সব ক্ষেত্রেই।

