ড. আহমদ কায়কাউস ছিলেন একজন আমলা, যাঁর উত্থান ছিল রূপকথার মতো। শুরুতে তিনি ছিল নিঃস্ব। কিন্তু হঠাৎ তিনি আলোচনায় আসেন পাদপ্রদীপ হিসেবে। সরকারি চাকরির সময় তিনি শিক্ষা ছুটি নিয়ে গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। সেখান থেকে পিএইচডি অর্জন করলেন, সঙ্গে মার্কিন নাগরিকত্বও গ্রহণ করেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফিরে তাঁর সরকারি চাকরি বহাল ছিল। এরপর দ্রুতই তিনি আমলাতন্ত্রের শীর্ষে উঠে আসেন, যেন এক অলৌকিক ঘটনা। আমলাতন্ত্রের মধ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি মাফিয়া রাজত্ব। সেখানে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের এক ভয়ঙ্কর চক্র গড়ে তোলেন। সেই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে তিনি দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তিনি বুঝতে পারেন, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে তার টিকে থাকা কঠিন হবে। তখনই তিনি সরকারের টাকায় বিদেশে চাকরি নেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের পতনের আগেই বিশ্বব্যাংকের চাকরি ছেড়ে একটি মার্কিন কোম্পানিতে যোগ দেন। বর্তমানে বিপুল সম্পদ বিদেশে পাচার করে বিত্তবৈভব নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন।
আহমদ কায়কাউস ছিলেন ৮৪ ব্যাচের আমলা, যিনি প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতাও ছিল সীমিত। না ছিলেন জেলা প্রশাসক, না মাঠের শীর্ষ পদে কাজ করেছেন। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তাঁর এই দ্রুত উত্থানের পেছনে ছিল এস আলমের প্রভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এস আলমের ঘনিষ্ঠ হন কায়কাউস। এস আলমের লুণ্ঠন প্রকল্পে প্রয়োজন ছিল এমন একজন আমলার, যিনি অর্থ পাচারে সাহায্য করবে। কায়কাউসকে বেছে নেয়া হয় এই কাজে। তিনি এস আলমের অবৈধ অর্থের সাম্রাজ্য গঠনে সহযোগিতা করেন। একই সঙ্গে নিজের জন্যও গড়ে তোলেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ।
এস আলমের নির্দেশনা অনুযায়ী পদায়ন করতেন তিনি, আর এর মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই তিনি শেখ হাসিনার পরিবারের বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি দেখভাল শুরু করেন। বিদ্যুৎ সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর একের পর এক কুইক রেন্টাল প্রকল্প অনুমোদন করেন তিনি। এসব থেকে তিনি ও তার ঘনিষ্ঠরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তার সময়ে ৩১টি কুইক রেন্টাল প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর আমলাতন্ত্রের সব গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর তার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বিদ্যুৎ, ব্যাংকিংসহ অন্যান্য খাতে নিজের বিশ্বস্ত লোকদের বসিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। আহমদ কায়কাউস ছিলেন আমলাতন্ত্রের মাফিয়া তন্ত্রের মূল কারিগর। তিনি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোতে দুর্নীতিবাজ আমলা বসিয়ে কমিশন বাণিজ্য চালাতেন। যেমন বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ে বাজেট বেড়ে যায় প্রকল্পের প্রকৃত খরচের তিন গুণ। সেখানে তিনি তার ঘনিষ্ঠ আমলাদের পদায়ন করতেন।
ব্যাংকিং সেক্টরে লুণ্ঠনের নেপথ্যে ছিলেন কায়কাউস। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে কোনো অর্থনীতিবিদ না রেখে একটি আমলাকে বসিয়েছিলেন, যিনি কায়কাউস ও এস আলমের দিক নির্দেশনায় কাজ করতেন। এর ফলে ব্যাংকিং সেক্টর লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে নিজের পছন্দের লোককে বসিয়ে সীমাহীন লুটপাট করেছেন তিনি। মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদদের কম ক্ষমতাবান করে আমলাদের ক্ষমতাবান করার কারিগর ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বেই আমলাতন্ত্র দুর্নীতির গহ্বর হয়ে উঠেছিল।
২০১৮ থেকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার ধীরে ধীরে আমলানির্ভর সরকারের রূপ নেয়। আমলারাই হয়ে ওঠে সর্বাধিকারী। ২০২০ সালের করোনাকালীন সময়ে কায়কাউস দেশের সর্বাধিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে দাড়ান। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তহবিল নেওয়া, ব্যাংকে চাপ সৃষ্টি, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান নেয়া—সব কিছুর পেছনে ছিলেন তিনি। তিনি প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ভেঙে প্রশাসনকে আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গসংগঠনে পরিণত করেছিলেন। এর ফলে আওয়ামী লীগ নামে যে সংগঠন ছিল, তার অবসান ঘটে।
কায়কাউস কোনো মন্ত্রীর বা রাজনৈতিক নেতার কথা শুনতেন না, শুধু শেখ হাসিনাকে মানতেন। তিনি নিজেই বলতেন, শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকে পাত্তা দিই না। তার আমলাতন্ত্র সিন্ডিকেট আমলাদের অবাধ লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছিল। নিজেও গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তার দুর্নীতি পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- প্রথমত, আমলাতন্ত্রের ভেতরে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেওয়া। সব মন্ত্রণালয়ের সচিব তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। উন্নয়ন প্রকল্প ও বরাদ্দের অর্থ লুণ্ঠন করা হত, তার অংশ পেতেন কায়কাউস। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০১৮-২০২৩ সালে সারা দেশে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য বরাদ্দ করলেও বাস্তবে কাজ হয়েছে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকার। বাকিটা লুণ্ঠিত হয়েছে।
- দ্বিতীয়ত, করোনাকালে টিকা ও চিকিৎসা সামগ্রীর জন্য খরচ হওয়া ১ লাখ কোটি টাকার মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। তার বড় অংশ পেয়েছেন কায়কাউস।
- তৃতীয়ত, এস আলমের নির্দেশে তিনি ব্যাংকিং সেক্টর অরাজকতায় ফেলে লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দুর্বল করে তোলেন।
- চতুর্থত, বিদ্যুৎ খাতকে লুণ্ঠনের জায়গা বানান। সচিব থাকাকালীন বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করেন।
- পঞ্চমত, বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন। যেমন আশ্রয়ণ প্রকল্পে গৃহহীনদের জন্য সরকারি বাড়ি নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম। কায়কাউস আমলাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, অবাধ দুর্নীতি ও লুটপাটের বিনিময়ে বাড়ি নির্মাণের সুযোগ নিতে। তাদের কেউ ১০ থেকে ৫০টি বাড়ি তৈরি করে পদোন্নতি ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। আর কায়কাউস পেয়েছেন কমিশন।
বর্তমানে কায়কাউস যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন। তিনি মার্কিন লবিস্ট ফার্ম মরান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিকে যোগ দিয়েছেন, যা সাবেক কংগ্রেসম্যান জেমস জি মরানের প্রতিষ্ঠিত। তার বিরুদ্ধে দু-একটি দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। দেশের আমলাতন্ত্রকে ধ্বংস করার মূল কারিগর হলেও তাকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। কেন তাকে ছাড় দেয়া হচ্ছে, তা এখন বড় প্রশ্ন।

