দেশজুড়ে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই পড়ার স্বপ্ন দেখেন দেশের প্রতিটি কোণার মেধাবী শিক্ষার্থীরা। তবে ভর্তির যুদ্ধ জিতেও শেষ হয় না শিক্ষার্থীদের লড়াই। বরং শুরু হয় আরেক যুদ্ধ—আবাসিক হলে একটি সিট নিশ্চিত করার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ায় এখনো রয়েছে সাবেকি কাঠামো। রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের ‘লাঞ্চের পরে আসেন’, ব্যাংকে দৌড়ঝাঁপ, হল-ডিপার্টমেন্টে কাগজপত্র—সব মিলিয়ে যেন এক প্রকৃত যুদ্ধ। আর এই হয়রানির শুরু ভর্তি থেকে, শেষ হয় সার্টিফিকেট তোলা পর্যন্ত।
হলে সিট পাওয়া কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। মেয়েদের হলে কল পদ্ধতিতে কিছু সংখ্যক সিট দেওয়া হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। যারা সময়মতো আবেদন করতে পারেন না, তাদের জন্য অপেক্ষা—আরো একটি বছর।
অনেক সময় রাজনীতিতে নাম লেখালেই মিলতো সিট। বিগত ১৫ বছরে রাজনৈতিক পরিচয়ে সিট পাওয়ার এই সংস্কৃতি ছিল অলিখিত নিয়ম। যদিও এমন শিক্ষার্থীদের মূল সংগ্রাম ছিল মাথা গোঁজার ঠাঁই।
১৯৭৭-৭৮ সেশনের এক প্রাক্তন ছাত্র জানান, তখন নম্বর ও বর্ষভিত্তিক সিট দেওয়া হতো। প্রথম বর্ষে শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধী ও উচ্চ নম্বর পাওয়া গুটিকয়েক শিক্ষার্থী সিট পেতেন। তবে রুম দখল আর রাজনৈতিক চাপে নিয়ম লঙ্ঘনের চিত্র তখনও ছিল।
চার সিটের রুমে থাকতেন ১২ জন, কোথাও ১৬-১৭ জন। সবাই টেবিল পেতেন না। পড়তে হতো বন্ধুর রুমে। সিট না পেলে কেউ কেউ বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন আরেক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ‘রেফারেন্স’। ডিপার্টমেন্ট প্রধান, শিক্ষক বা প্রভাবশালী কারো পরিচয়ে পাওয়া যায় সিট। তবে এর জন্য জমা দিতে হয় বিশাল ফরমালিটিজ: অভিভাবক, মার্কশিট, আয়ের সনদসহ সত্যায়িত কাগজপত্র।
সবচেয়ে কঠিন বিষয়—২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় এসে অভিভাবকের সাক্ষাৎকার। দূরবর্তী জেলা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য এটি প্রায় অসম্ভব। তবু সময়মতো না এলে সিট বাতিল।
সিট পেলে শুরু হয় আরেক দৌড়: ব্যাংকে টাকা জমা, রশিদ জমা, পরিচয়পত্র বানানো। এসব করতে শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় এক দফা হয়রানিতে। শুধু তাই নয়, সিট পেলেও কারো ভাগ্যে আসে নতুন ভবন, কারো ভাগ্যে পড়ে জরাজীর্ণ ভবন।
উদাহরণ হিসেবে ২০২৩-২৪ সেশনের এক ছাত্রীর মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতার পরও একটি সিঙ্গেল সিটের জন্য তাকে দৌড়াতে হয়েছে বিভাগের শিক্ষক থেকে শুরু করে মেডিকেল অফিস পর্যন্ত।
তিনি বলেন, “জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসে কিন্তু ফরমালিটিজ ফুরায় না।”
রোকেয়া হলের ৭ মার্চ ভবনে আধুনিক সুবিধা থাকলেও অপরাজিতা ভবনের অবস্থান করুণ। সেখানে আলো-বাতাস নেই, নেই ঠিকঠাক টয়লেট, নেই সুস্থ থাকার পরিবেশ। এমনকি ওয়াশিং মেশিন বিতরণেও এই ভবনের নাম বাদ পড়ে।
শামসুন্নাহার হলের এক শিক্ষার্থী জানান, এক রুমে ৮ জন, সিঙ্গেল সিট মাস্টার্সের আগেই মিলবে—এমন আশা করা বৃথা। অথচ কিছু ভবনে একই রুমে দুইজন থাকে। ভালো সিজিপিএধারীদের সুযোগ দেওয়া হলেও, রেফারেন্স ছাড়া সেই সুযোগও কঠিন।
সুফিয়া কামাল হলে মাস্টার্সের আগে সিঙ্গেল সিট না দিলেও, রোকেয়া ও কুয়েত মৈত্রীতে তা দেওয়া হয় চতুর্থ বর্ষেই। তবু বাস্তবে এসব নিয়ম কার্যকর নয়। শিক্ষার্থীদের নিজেরাই সিট খুঁজে ‘ফ্লোর ম্যাম’ ও ‘সেশন ম্যাম’-এর কাছে নিয়ে যেতে হয়।
আর সিট না দিলে প্রতিবাদ? নীরবতা! কারণ, প্রতিবাদ মানে সিট হারানোর ভয়।
২০১৬-১৭ সেশনের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী অপর্ণা বিশ্বাসের কথা উল্লেখযোগ্য। সিট ছাড়ার নির্দেশ পেয়েছেন। কিন্তু সিট কাটাতে এখনো দৌড়ঝাঁপ করছেন। চোখে না দেখতে পারলেও সাহায্যের হাত বাড়ায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তিনি বলেন, “সার্টিফিকেট তুলতে হলে সিট কাটাতেই হবে। অথচ আমার মতো শিক্ষার্থীদের জন্য সামান্য সহানুভূতিও নেই।”
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। আবাসনের সুযোগ ১৬ হাজারের জন্য। ফলে বাকি শিক্ষার্থীরা থাকেন বাইরে বা দ্বৈত আবাসিক হিসেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস যেসব এলাকায় যায় বা যাদের পরিবার ঢাকায়, তারা সিটের জন্য বিবেচিত হন না।
প্রশাসনের বক্তব্য হচ্ছে: “সমস্যা আমরা জানি, সমাধানে সময় লাগবে”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা বলেন, “সিস্টেম পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভব না। কাজ চলছে। সময় লাগবে।” তিনি জানান, নারীদের হল সংকট কমাতে মাসিক ৩ হাজার টাকা হোস্টেল ভাতা দেওয়া হচ্ছে। নতুন নারী হল নির্মাণ নিয়েও ভাবনা চলছে।
‘জুলাই আন্দোলন’ বদল আনলো কি?
ছাত্রী নির্যাতনের পর ‘জুলাই আন্দোলন’ দেশের রাজনীতিতেই নাড়া দিয়েছিল। ছাত্রলীগের দমননীতি ছাত্রীরা রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও প্রশ্ন রয়ে গেছে—তাদের প্রতি বৈষম্য কি কমেছে?
হিসাব বলছে: ১৪টি ছেলেদের হল, মেয়েদের মাত্র ৫টি
এই বিশাল বৈষম্যই যেন শিক্ষার্থীদের কষ্টের মূল কারণ। ভর্তির স্বপ্ন নিয়ে আসা হাজারো ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন, প্রটোকল, আর সিস্টেমের চাপে পড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
পরিশেষে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও, হলে একটি সিট পাওয়া যেন আরেক যুদ্ধ। সেখানে নিয়মের চেয়ে বেশি চলে ‘কোথায় যাবে, কার রেফারেন্স আছে’। আর বিশ্ববিদ্যালয়—সব জানে, সব দেখে কিন্তু চুপচাপ বসে থাকে।

