এক সময় যার গ্রামের বাড়িতে থাকার মতো একটি ভালো ঘর ছিল না, সেই আবদুর রাজ্জাক ওরফে সোলাইমান রিয়াদ রাজধানী ঢাকায় এখন একাধিক ভাড়া বাসার মালিক। অভিযুক্ত এই ছাত্রনেতা আওয়ামী লীগের সাবেক এক নারী সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর রিমান্ডে মুখ খুলেছেন নিজের অপরাধ জগতের বিস্তৃতি নিয়ে।
গুলশান থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, রিয়াদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে (৩০ জুলাই) ভোরে রাজধানীর বাড্ডায় তার একটি ভাড়া বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে একটি ছোট ওয়ার্ডরোব থেকে উদ্ধার হয় প্রায় ৩ লাখ টাকা।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, “রিয়াদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আমাদের টিম তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাসায় অভিযান চালায়। বাসাটিতে একটি রুমে একাই থাকতেন রিয়াদ। সেখানেই টাকা রাখা ছিল।”
ওসি আরও জানান, “ঢাকায় রিয়াদের দুটি ভাড়া বাসা শনাক্ত হয়েছে—একটি বাড্ডার বৈখাল এলাকায়, আরেকটি পশ্চিম রাজাবাজারে। বাড্ডার বাসায় তিনি নিয়মিত থাকতেন, অন্যটিতে মাঝে মধ্যে যেতেন।”
বাড্ডার ফ্ল্যাটটি চার রুমের। বাকি তিন রুমে কয়েকজন শিক্ষার্থী থাকেন। রিয়াদ একাই একটি রুম দখলে রেখেছিলেন।
সাবেক এমপির বাসায় চাঁদাবাজি
গত ২৬ জুলাই আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির অভিযোগে রিয়াদসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শাম্মীর স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর গুলশান থানায় একটি মামলা করেন।
মামলায় রিয়াদ ছাড়াও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন নেতা ও আরও ১০-১২ জন অজ্ঞাত পরিচয় আসামির নাম উল্লেখ করা হয়।
আসামিদের মধ্যে রয়েছেন:
- গৌরব জামান ওরফে অপু
- ইব্রাহিম হোসেন ওরফে মুন্না
- সাকাদাউন সিয়াম
- সাদমান সাদাব
- একজন কিশোর বয়সী ছেলে
পুলিশ জানায়, এই চক্রটি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিভক্ত হয়ে চাঁদাবাজি ও তদবির বাণিজ্য চালায়। তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন রিয়াদ ও অপু।
টার্গেটে প্রভাবশালী রাজনীতিক ও প্রতিষ্ঠান
রিমান্ডে রিয়াদ জানান, তাদের মূল টার্গেট ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব স্থানে চাঁদা তুলতে ‘সোর্স’ বা তথ্যদাতাদের সহায়তা নিতেন। চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা না পেলে ‘মব’ সৃষ্টি করে হুমকি দিতেন।
পুলিশ জানায়, রিয়াদ-অপু নেতৃত্বাধীন এই চক্র থানা, দলীয় পরিচয় ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন স্থানে তদবিরও করতেন। একটি আলোচিত ঘটনায় দেখা যায়, রাজধানীর গ্রিন রোডে অবস্থিত সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদের পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ৫ কোটি টাকার চেক লিখে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে রিয়াদের বিরুদ্ধে।
‘মব’ দিয়ে চেক আদায়
প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার ও আজাদের শ্যালক সাইফুল ইসলাম জানান, “রিয়াদ নেতৃত্বে ছয়জন আমাদের অফিসে ঢুকে সবার মোবাইল কেড়ে নেয় এবং টাকা দাবি করে। তারা বলে, নিচে ২০০ লোক অপেক্ষায় আছে। গায়ে থাপ্পড় কিংবা জুতা পড়ুক, আপনি চান? টাকা দেন।”
তিনি বলেন, “অস্বীকৃতি জানালে তারা টেবিল খুঁজে ব্যাংকের চেক বই পায়। এরপর জোর করে ৫ কোটি টাকার একটি চেক লিখিয়ে নেয়।”
এই ঘটনায় আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের জমি দালাল মুক্তার নামে এক ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। অভিযোগ, মুক্তারই রিয়াদ ও অপুর তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করতেন।
তবে মুক্তার হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি জমির দালালি করি কিন্তু ওদের ডেকে আনিনি।”
রিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় পুলিশ পশ্চিম রাজাবাজারের বাসা থেকেও চারটি চেক উদ্ধার করে। এসব চেকে মোট ২ কোটি ২৫ লাখ টাকার স্বাক্ষর ছিল। চাঁদাবাজির অংশ হিসেবেই এসব চেক নেওয়া হয়েছিল বলে পুলিশ জানায়।
ভুক্তভোগী সাবেক এমপি আজাদ এই ঘটনায় এখনো মামলা করেননি। তাঁর আত্মীয় সাইফুল ইসলাম জানান, “মূল আসামিরা এখন গুলশান থানায় রিমান্ডে আছে। সেটি শেষ হলেই দ্রুত বিচার আইনে মামলা করব। প্রস্তুতি চলছে।”
গুলশান থানার ওসি হাফিজুর রহমান জানান, “রিমান্ডে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। কেউ তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজ্জাক (রিয়াদ) মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করতেন। পলাতক অপুকেও খোঁজা হচ্ছে।”

