যাদের দায়িত্ব ছিল মাদক রোধে মাঠে থাকা, এবার তাদের বিরুদ্ধেই উঠেছে চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির অভিযোগ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অন্তত ১০ কর্মকর্তা ঘুষ, চাঁদাবাজি, স্বর্ণ ছিনতাই ও চেক লুটের মতো অপরাধে জড়িত থাকায় গত জুলাই মাসে বরখাস্ত হয়েছেন।
অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা সাজানো অভিযানে গিয়ে তুলে এনেছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। কাউন্সিলরের বাসায় অভিযানে অংশ নিয়ে লুটপাটেও জড়িয়েছেন কেউ কেউ। এমনকি স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেওয়ার মতো অপরাধেরও প্রমাণ মিলেছে। ঘুষ নিয়ে কেমিক্যাল ব্যবহারের লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
ডিএনসি সূত্র জানায়, গত এক মাসে বরখাস্ত করা হয়েছে ১০ জন কর্মকর্তাকে। একজন সহকারী পরিচালককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। আরেকজনের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ এবং একজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সংস্থায় চলছে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি। এর আগেও অনেক অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেওয়া হতো না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এখন প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২৪ জুলাই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে সহকারী পরিচালক মো. বাবুল সরকারকে (পরিচিতি নং ১৩০৭২)। প্রমাণ পাওয়া গেছে, তিনি গাজীপুরের মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামক একটি গার্মেন্টসে অভিযান চালিয়ে এসিটোন ব্যবহারের প্রমাণ পেলেও ব্যবস্থা না নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেন। পরে আরও ১০ হাজার টাকা সমঝোতায় নেন এবং লাইসেন্স দেওয়ার আশ্বাসে দাবি করেন ১৫-১৬ লাখ টাকা। ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর আরেকটি কারখানায় একইভাবে ভয় দেখিয়ে ৫০ হাজার টাকা দাবি এবং পরে আরও ৬ লাখ টাকা নেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। চিঠিতে আরও উল্লেখ, বাবুল সরকার ২০১৭ সালে চাকরিতে যোগ দিলেও তার আচরণগত সমস্যা ও দুর্নীতির কারণে এখনো চাকরি স্থায়ী হয়নি এবং দুইটি বিভাগীয় মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন।
২২ জুন গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ রমিজ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। পরে তার বাসা থেকে ১৫ হাজার ইয়াবা উদ্ধার দেখালেও, অভিযোগ ওঠে কর্মকর্তারা ব্যাংক চেক নিয়ে গেছেন, যা এজাহারে উল্লেখ ছিল না। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বরখাস্ত করা হয় পরিদর্শক শাহরিয়া শারমিন, উপপরিদর্শক আবদুল আল মামুন ও মো. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহকারী উপপরিদর্শক মো. আতাউল হক এবং সিপাহি সোহেল রানা—এই পাঁচজনকে। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
সিপাহি মো. সোহেল রানার বিরুদ্ধে অভিযোগ, পটুয়াখালীতে কর্মরত অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে অভিযান পরিচালনা করে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২১.৪ ভরি স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেন। তদন্তে আরও উঠে আসে, তিনি সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন। এ কারণে তার বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ১৮ জুন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে সাবেক কাউন্সিলর ছালেহা বেগমের বাসায় অভিযান চালায় ডিএনসি। কোনো মাদক না পেয়ে তেল খরচ বাবদ ১০ হাজার টাকা নেন কর্মকর্তারা। পরে ফের বাসায় ঢুকে ১০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার দেখিয়ে আলমারি থেকে প্রায় ৮ লাখ টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম, সহকারী উপপরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও শামীম আল আজাদকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আগে বহুবার অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ উঠলেও বেশিরভাগ সময় তদন্তের নামে তা ধামাচাপা দেওয়া হতো। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। অভিযোগ উঠলেই দ্রুত তদন্ত ও শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে।

