খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার কৃষকরা যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানামুখী সংকটে জর্জরিত, ঠিক সেই সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি বরাদ্দের অর্থ নয়ছয় করে গড়ে তোলা হয়েছে দুর্নীতির সাম্রাজ্য। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ বাছিরুল আলম।
২০২৪ সালের ১৭ এপ্রিল খাগড়াছড়ির উপপরিচালক কিশোর কুমার মজুমদারের বদলির পর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পান জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ বাছিরুল আলম। আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপুর আশীর্বাদে এ পদে বসেন তিনি। প্রশিক্ষণ কর্মকর্তার পদমর্যাদা নিয়েও তিনি এক বছরের বেশি সময় ধরে উপপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। আর সেই দায়িত্বের সুযোগ নিয়ে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়েছে তার নামে।
গত বছরের শেষ দিকে শীতকালীন সবজি উৎপাদনের জন্য ৯ উপজেলার ৮ হাজার কৃষকের মধ্যে হাইব্রিড সবজি বীজ বিতরণের প্রকল্প নেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এতে মোট বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, একটি কোম্পানির সঙ্গে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ১ হাজার ২৫০ টাকার বীজ ১ হাজার ৮০০ টাকা দেখিয়ে অতিরিক্ত ৫৫০ টাকা করে তুলে নেন বাছিরুল। এতে প্রকল্পের ৪৪ লাখ টাকা সরাসরি আত্মসাৎ হয়।
জেলা পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরার সঙ্গে যোগসাজশে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ সরকারি ক্রয়নীতিমালা (পিপিআর ২০০৬ ও ২০০৮) অনুসারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল, যা মানা হয়নি। ওই সময় জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চৌধুরী এই অনিয়মের বিষয়ে লিখিত নির্দেশ দিলেও তা উপেক্ষা করা হয়।
গত শীতে পেঁয়াজ চাষে ১৮টি প্রদর্শনীর জন্য বরাদ্দকৃত বীজের অর্ধেকই দেওয়া হয়নি কৃষকদের। প্রতি প্রদর্শনীতে ১ কেজি করে বীজ দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫০০ গ্রাম করে। এতে ৫৪ হাজার টাকার গরমিল হয়েছে। গোপন সূত্র বলছে, ১৭ জন কৃষকের নামে ১ কেজি করে পেঁয়াজ বীজ বিতরণ দেখানো হলেও বাস্তবে তারা কিছুই পাননি। এতে আরও আত্মসাৎ হয় প্রায় ১ লাখ ২ হাজার টাকা। কিছু কৃষক জানান, ৫০০ গ্রাম বীজ পেয়েও কর্মকর্তাদের নির্দেশে ১ কেজি পেয়েছেন বলে বলার চাপ ছিল। অন্যথায় ভবিষ্যতে কোনো সহায়তা দেওয়া হবে না বলে হুমকি পান তারা।
অড়হর চাষে প্রতিজন কৃষককে ২ কেজি করে বীজ দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয়েছে মাত্র ১ কেজি বা তারও কম। এখনও মাঠপর্যায়ে চলছে বণ্টনের নামে কাগজে-কলমে হেরফের। পারিবারিক পুষ্টিবাগান প্রকল্পের আওতায় ৩০ জন কৃষকের পরিবর্তে ২০ জনকে নিয়ে তিন দিনের মোটিভেশনাল ট্যুর মাত্র একদিনেই শেষ করেন বাছিরুল। মাস্টাররোলে তিন দিনের সই নিয়েই সম্পন্ন হয় পুরো লেনদেন। এতে সরাসরি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। গুইমারা ও পানছড়ি উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বিষয়টি অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বীকার করেছেন। তবে তারা এ নিয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ইউএনডিপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৪টি রাইস হার্ভেস্টার মেশিন কেনা হয়। খরচ হয় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদ শেষে ঠিক এক মাস আগে পানছড়ি উপজেলার একটি যন্ত্র ‘গায়েব’ হয়ে যায়। অভিযোগ উঠেছে, খাগড়াছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ব্যক্তিগত সহকারী খগেন্দ্র ত্রিপুরার সহায়তায় এই যন্ত্র বিক্রি করে দেন বাছিরুল। গায়েব যন্ত্রের দাম প্রায় ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু এই ঘটনায় নীরব রয়েছে কৃষি বিভাগ ও জেলা পরিষদ।
দুর্নীতির এসব অভিযোগের পাশাপাশি ছড়িয়েছে বিত্ত-বৈভবের খবর। ঢাকার মিরপুরে নিজের ফ্ল্যাট, উত্তরায় প্লট, দামি গাড়ি ও সম্পত্তির গুঞ্জন রয়েছে বাছিরুলকে ঘিরে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বাছিরুল আলম জানান, “আমার পৈতৃক বাড়ি পুরান ঢাকায় ও ফ্ল্যাট আছে শেওড়াপাড়ায়। সব কিছুই বেতনের টাকায় কেনা। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।”
এই অনিয়মের অভিযোগে জানতে চাওয়া হলেও জেলা পরিষদের দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কৃষি পুনর্বাসন কমিটির আহ্বায়ক জিরুনা ত্রিপুরার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আহ্বায়ক ও জেলা পরিষদের সদস্য কংজ্যপ্রু মারমা বলেন, “বীজ কেনার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তবে ট্যুর একদিনে শেষ করার অভিযোগ শুনেছি। আপাতত এর বেশি কিছু বলছি না।

