নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা ধরনের নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও নারী অধিকারবিষয়ক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক চিত্র।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এবং জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে কয়েকশ নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা, আত্মহত্যা, হত্যা, অপহরণ, গৃহকর্মী নির্যাতনসহ নানা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৩১ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, শুধু জুন ও জুলাই মাসেই নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩৮ জন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫১ জন—যাদের মধ্যে ৩২ জন কন্যা ও ১৯ জন নারী। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১ জন কন্যাকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে আরও ১০ জনকে। অতিরিক্ত যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৫ জন। এসিড ও আগুনে দগ্ধ হয়েছেন ৭ জন নারী। তাদের মধ্যে একজন আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন—তিনজন কন্যাশিশু ও ১৪ জন নারী। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩ জন নারী।
এই মাসেই হত্যা করা হয়েছে ৭৮ জন নারী ও কন্যাশিশুকে। এর মধ্যে নারী ৫৬ জন এবং কন্যা ১০ জন। হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে ১ জনকে। রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৬ জন, অপহৃত হয়েছেন ১০ জন। গৃহকর্মী নির্যাতনে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন। পাচারের শিকার হয়েছেন ১০ জন নারী। বাল্যবিয়ের চেষ্টা করা হয়েছে ২ জন কন্যার ক্ষেত্রে। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছেন আরও ৯ জন নারী।

ধর্ষণের ভয়াবহতা বাড়ছে:
আসকের তথ্য বলছে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন, যার মধ্যে ৪৪ জনই শিশু। জানুয়ারিতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি, দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ১৮টি। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭টিতে। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা দুইটি। এই মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৬ জন শিশু ও ১৭ জন কিশোরী। শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি। প্রতিবন্ধী নারী ও কিশোরীদেরকেও রেহাই দেয়নি ধর্ষকরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪০১ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে এবং আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। ২০২৪ সালে গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১ জন নারী। যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ১৬৬ জন। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন দুইজন ও খুন হয়েছেন তিনজন। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫২৩ জন নারী। এর মধ্যে ২৭৮ জন নির্যাতনে মারা গেছেন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১৭৪ জন।
রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক অবহেলা:
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ছিল চোখে পড়ার মতো। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। জাতিসংঘের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময় শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হন। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, “নির্বাচিত সরকারের সময় অন্তত কিছু উদ্যোগ দেখা যেত, এখন সেটাও অনুপস্থিত। বরং নিপীড়কদের অনেক সময় পুনর্বাসন করতে দেখা যায়।”

সরকারের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিশ্রুতি:
চলমান সহিংসতার ঘটনায় চাপে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। মাগুরায় আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে সরকারের পক্ষ থেকে সময়সীমা কমানোর ঘোষণা এসেছে। ধর্ষণ মামলার তদন্ত ১৫ দিনের মধ্যে শেষ করার এবং বিচার ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করার আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপের কথা জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি জানান, যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে ২৪ ঘণ্টার হটলাইন চালুর প্রস্তুতিও চলছে। রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানির শিকার হলে সরাসরি অভিযোগ জানানোর সুযোগ থাকছে হটলাইনে।
রাজপথে বিক্ষোভ, ক্যাম্পাসে উত্তেজনা:
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ হচ্ছে। ঢাবির রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে শাহবাগ, নীলক্ষেত, ভিসি চত্বর হয়ে শিক্ষার্থীরা লাঠি হাতে মিছিল করেছে। ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি তুলেছেন। তাদের অন্যতম দাবি—ধর্ষণের বিচার দ্রুত ট্রাইব্যুনালে সম্পন্ন করতে হবে এবং ব্যর্থতার দায়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অপসারণ করতে হবে। শিক্ষার্থী আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, “প্রকাশিত ঘটনাগুলো আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র। সামাজিক চাপ ও ভয় দেখিয়ে অনেক নির্যাতনের ঘটনা চাপা দেওয়া হয়।” বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন, “সমাজে নারীবিদ্বেষী মনোভাব বাড়ছে। ধর্মকে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। পোশাক, চলাফেরায় বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব ঘটনা যে কোনো সভ্য সমাজের জন্য অশনিসংকেত।”
এই পরিসংখ্যান ও ঘটনার ধারাবাহিকতা একটি গুরুতর সংকেত দেয়। রাষ্ট্র ও সমাজ উভয় স্তরেই প্রতিরোধের ঘাটতি স্পষ্ট। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এখন শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার, সামাজিক স্থিতিশীলতার ও মানবাধিকারের সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণে আইন, প্রশাসন, শিক্ষা, ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও সামাজিক চেতনার গভীর সংস্কার জরুরি।

