সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবৈধ সম্পদ অর্জনের তদন্ত চলার মধ্যেই এবার প্রশ্ন উঠেছে তার ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েও। ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। কিন্তু তদন্তে উঠে এসেছে, এই ডিগ্রি অর্জনে তিনি ভর্তির শর্ত পূরণ করেননি। বরং ভর্তি ফরমে দিয়েছেন ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য।
২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিবিএ প্রোগ্রামে তিনি প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন। নিয়ম অনুযায়ী, ডিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য আগের সব পাবলিক পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ বেনজীর আহমেদ এসএসসি, এইচএসসি ও বিএ (পাস) পরীক্ষায় যথাক্রমে ৪৭, ৪৬ ও ৪৬ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন।
এই যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সুপারিশে তাকে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তি করানো হয়। এমন সুপারিশে বলা হয়েছিল, বেনজীর ‘ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার এবং র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন, সমাজের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি’ হিসেবে তার ভর্তির মাধ্যমে সমাজ উপকৃত হবে।
ভর্তি প্রক্রিয়ায় মিথ্যা তথ্য প্রদান:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমদ খান জানান, বেনজীর আহমেদের ভর্তি ফরমে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছিল। ফরমে নথির ক্রমিক নম্বর ৫৪-এ নীল কালি ব্যবহার করা হলেও শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে কালো কালি ব্যবহার করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়। এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনুচিত সুবিধা নেওয়ার প্রচেষ্টা ছিল বলে মনে করে তদন্ত কমিটি। বেনজীর আহমেদের ডক্টরেট ডিগ্রি ঘিরে বিতর্কের প্রেক্ষাপটে উচ্চতর তদন্তে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পাঁচ সদস্যের একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করে। গত ২০ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়—সিন্ডিকেটের সভায় এই তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান।
ডিবিএ ডিগ্রি আসলে কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মীজানুর রহমান, যিনি বেনজীর আহমেদের ডিফেন্স বোর্ডের আহ্বায়ক ছিলেন, বলেন, ডিবিএ কোনো পূর্ণাঙ্গ ডক্টরেট ডিগ্রি নয়। এর মান সাধারণ স্নাতকোত্তর ডিগ্রির চেয়ে সামান্য বেশি। তাই এই ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে নামের আগে ‘ড.’ ব্যবহার করা নৈতিকভাবে যথাযথ নয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও প্রশ্ন তুলেছে—ডিবিএ কি আদৌ ‘ডক্টরেট’ হিসেবে গণ্য করা যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি অর্জনে ভর্তির আগে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর থাকতে হয় এবং অবশ্যই নির্দিষ্ট কোর্স ওয়ার্ক, সেমিনার, গবেষণা প্রকাশনা পূর্ণ করতে হয়। ডিবিএ প্রোগ্রামের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ৩০ ঘণ্টার কোর্স ওয়ার্ক করা বাধ্যতামূলক। তবে বেনজীর এই কোর্স করেছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কর্মরত অবস্থায় কীভাবে তিনি নিয়মিত ক্লাস করেছেন বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা ক্লাস নিয়েছেন, তা নিয়েও কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি রেগুলেশনে বলা হয়েছে, গবেষণা শুরুর আগে কমপক্ষে দুটি উন্মুক্ত সেমিনার আয়োজন করতে হবে এবং গবেষণা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশ করতে হবে। বেনজীরের ‘বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অর্থনৈতিক অবদান’ বিষয়ে গবেষণাটি কোনো জার্নালে প্রকাশিত হয়নি বলে জানা গেছে। তবে এই বিষয়ের ওপর তাঁর একটি বই ২০২৩ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল।
‘ডক্টরেট’ নিয়ে আমলাদের আগ্রহ:
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে—ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আমলারা কর্মরত অবস্থায় নিয়মবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি বা সমমানের ডিগ্রি নিচ্ছেন। বিদেশে ডিগ্রি নিতে হলে কঠোর মানদণ্ড পূরণ করতে হয়, সেখানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ডিগ্রি অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকরভাবে দিচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপের মতো সরকারি প্রকল্পেও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি ও থাকা-খাওয়ার সব খরচ মেটানো হয়। অথচ দেশেই অনেকেই নিয়ম না মেনে উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন—শুধু নামের আগে ‘ড.’ লেখার খায়েসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়:
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব নিয়ম ভেঙেই বেনজীরকে ভর্তির অনুমতি দিয়েছে। ৭৩ অধ্যাদেশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাধরদের জন্য নিয়ম আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। এই ডিগ্রি দেওয়ার মাধ্যমে শুধু একজন ব্যক্তিই নয়, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
তদন্ত কমিটি ও তাদের পর্যবেক্ষণ:
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির আহ্বায়ক হলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ। সদস্য হিসেবে রয়েছেন আইন অনুষদের ডিন ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এবিএম শহিদুল ইসলাম, সিনেট সদস্য রণজিৎ কুমার সাহা এবং রেজিস্ট্রার মুন্সী শামস উদ্দিন আহমদ। কমিটি ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেবে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেনজীর আহমেদের ডিগ্রি প্রদানে নিয়ম বহির্ভূত সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং তিনি ভর্তির প্রয়োজনীয় যোগ্যতা পূরণ করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেনজীর আহমেদের ডিগ্রি স্থগিত করেছে। তদন্তে অনিয়মের সত্যতা প্রমাণ হলে তার ডিগ্রি বাতিলের পাশাপাশি যেসব কর্মকর্তা এই অনিয়মে জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য রণজিৎ কুমার সাহা এই ডিগ্রি বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা এড়াতে যা করা প্রয়োজন:
- ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন।
- ভর্তির যোগ্যতা যাচাইয়ে বহিরাগত নিরপেক্ষ কমিটি গঠন।
- গবেষণা ও প্রকাশনার মান যাচাইয়ের জন্য স্বাধীন পিয়ার-রিভিউ বোর্ড গঠন।
- বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখার উদ্যোগ।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রাচীনতম ও মর্যাদাপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে নীতির প্রশ্নে আপসহীন থাকা, আর অনিয়মে জড়িতদের কঠোরভাবে জবাবদিহির আওতায় আনা। এটি কেবল একটি ব্যক্তির ডিগ্রি বাতিলের প্রশ্ন নয়, এটি দেশের শিক্ষা ও নৈতিকতার ভবিষ্যৎ রক্ষার লড়াই। সবার মনে রাখা উচিত—একটি ডিগ্রি কাগজে লেখা থাকতে পারে, কিন্তু একজন প্রকৃত পণ্ডিত হয়ে উঠতে হয় সততা, জ্ঞান ও দায়বদ্ধতার মাধ্যমে।
পরিশেষে বলা যায়, ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন একাডেমিক জীবনের সর্বোচ্চ মাইলফলক। এটি কেবল একটি ডিগ্রি নয়, বরং একজন গবেষকের মৌলিক চিন্তা, কঠোর পরিশ্রম এবং সততার স্বীকৃতি। সেই মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি যদি ভুয়া যোগ্যতা, প্রভাব খাটানো ও প্রশাসনিক সুবিধা নিয়ে অর্জিত হয়—তাহলে তা পুরো শিক্ষাব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নিজের নিয়ম ভেঙে ক্ষমতাবানদের বিশেষ সুবিধা দেয়, তখন তা কেবল একটি ডিগ্রির অনিয়ম নয়, বরং গোটা সমাজে ‘ক্ষমতাই ন্যায়’—এই বার্তাটি পৌঁছে দেয়। আর সেটিই সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

