দেড় বছর আগে প্রায় ৩৫৮ কোটি টাকায় ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। উদ্দেশ্য ছিল পণ্য পরিবহন খাত থেকে আয় বাড়ানো। কিন্তু দুর্বল পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে ভ্যানগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশই অলস পড়ে আছে। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব তো বাড়েনি, বরং আগের তুলনায় কমেছে। এ অবস্থায় রেলওয়ে এখন ভ্যানগুলো বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার চিন্তায় রয়েছে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ ভ্যান কেনা হয়। প্রতিটি মিটারগেজ ভ্যানের দাম ২ কোটি ৪৫ লাখ এবং ব্রডগেজের দাম ৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। প্রতিটি ভ্যান ১০ টন পণ্য পরিবহন করতে পারে।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে এসব ভ্যান যুক্ত হয় রেলের বহরে। এর মধ্যে ২৫টি ছিল রেফ্রিজারেটেড ভ্যান। তবে উদ্বোধনের এতদিন পরও এই ২৫টি রেফ্রিজারেটেড ভ্যান একদিনও ব্যবহার করা হয়নি। বর্তমানে রেলের মোট ১৪৩টি লাগেজ ভ্যানের মধ্যে সচল আছে মাত্র ৬৩টি। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ২১টি ও পশ্চিমাঞ্চলে ২৪টি চলছে। এছাড়া ব্যবহৃত হচ্ছে ১০টি ভেইকল লাগেজ ভ্যান এবং ৮টি গার্ড ব্রেক।
নতুন ভ্যান যুক্ত হওয়ার আগে ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে রেলওয়ের আয় হয়েছিল ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা, পরিবহন হয়েছিল ৭০ হাজার ৯০০ টন পণ্য। অথচ ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে আয় নেমে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ২৯ লাখ টাকায়। পণ্য পরিবহনের পরিমাণও কমে দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৪০০ টনে। অর্থাৎ, ভ্যান বাড়লেও রাজস্ব কমেছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভ্যানগুলো শুধু মেইল ট্রেনেই নয়, আন্তঃনগর ট্রেনেও যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আন্তঃনগর ট্রেন অধিকাংশ স্টেশনে থামে না, আর যেসব স্টেশনে থামে, সেখানেও থেমে থাকে মাত্র ৩-৫ মিনিট। এত স্বল্প সময়ে পণ্য ওঠা-নামা সম্ভব নয়। ২০২৩ সালের ২৪ অক্টোবর রেলওয়ে খুলনা, পঞ্চগড় ও রহনপুর রুটে ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’ চালু করেছিল। কিন্তু কৃষকদের সাড়া না পেয়ে এক সপ্তাহের মধ্যেই তা বন্ধ হয়ে যায়। কিছু ট্রেনে দুই লাখ টাকার ডিজেল খরচ হলেও আয় হয়নি দুই হাজার টাকাও।
রেলের তথ্য বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে লাগেজ ভ্যানে প্রতিকেজি পণ্যের ভাড়া ২ টাকা ৩৬ পয়সা। অথচ সড়কে এই ভাড়া পড়ে ১ টাকা ৬৮ পয়সা থেকে ২ টাকার মধ্যে। ট্রেনে পাঠালে একাধিকবার পণ্য ওঠা-নামার কারণে খরচ ও ঝুঁকি বেড়ে যায়। যশোর থেকে ঢাকায় ট্রাকে সবজি পাঠাতে খরচ পড়ে ২ টাকা কেজিতে। কিন্তু ট্রেনে পাঠাতে খরচ পড়ে প্রায় সাড়ে ৪ টাকা। ফলে ব্যবসায়ীরা ট্রেনের চেয়ে ট্রাককেই বেশি পছন্দ করেন।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, লাগেজ ভ্যান কেনার আগে চাহিদা যাচাই করা হয়নি। করোনাসহ নানা কারণে গত দেড় দশকে রেলের প্রায় ৯৩টি ট্রেন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে, যার বেশিরভাগই ছিল মেইল ও লোকাল ট্রেন—যেগুলোতে লাগেজ ভ্যান ব্যবহার হতো।
বুয়েটের পরিবহনবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক বলেন, “সঠিক কার্যকারিতা যাচাই না করেই ভ্যান কেনা হয়েছে। অনেকে সরবরাহকারীদের সুবিধা করে দিতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়। এর দায় কেউ নেয় না। সরকারের উচিত তদন্ত করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।”
রেলওয়ে বর্তমানে ভ্যানগুলো বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারির এক সভায় ‘পার্সেল ও গুডস পরিবহন নীতিমালা ২০২৪’ খসড়া চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। সভায় জানানো হয়, রেলের মোট লাগেজ ভ্যানের মাত্র ৫ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই বেসরকারি খাতে পরিচালনার মাধ্যমে আয় বাড়ানো সম্ভব হবে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, “ভ্যানগুলো মূলত মেইল ও লোকাল ট্রেনে ব্যবহৃত হতো। এখন সেসব ট্রেন বন্ধ। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ডাক বিভাগের সঙ্গেও কথা হচ্ছে, তবে তাদের ভাড়া হার পুরোনো হওয়ায় তা পুনঃনির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।”

