গত সাত মাসে গাজীপুর মহানগর ও জেলায় ১০৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। যেই তথ্য গত শনিবার প্রকাশিত সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, এটা উদ্বেগজনক হলেও বিস্ময়কর নয়। বিশেষত এই বৎসরের জানুয়ারি হতে জুন পর্যন্ত পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ সমগ্র দেশে সংঘটিত খুনের পরিসংখ্যানে এই উপসংহারই অনিবার্য হয়ে উঠে।
সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনমতে, যেখানে ২০২০ হইতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি ছয় মাসে সমগ্র দেশে গড়ে খুনের মামলা হয়েছে এক সহস্র ৬১৩টি, সেখানে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট খুনের মামলা হয়েছে এক সহস্র ৯৩৩টি। শুধু উহাই নহে, সমকালের এক প্রতিবেদনমতে, ১১ মাসে চট্টগ্রামের রাউজানেই ১৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, গুরুতর অপরাধের ঘটনায়ও অতীতে পুলিশ খুব কম ক্ষেত্রেই দ্রুত তৎপর হয়েছে।
সেই চিত্র পাল্টানোর উল্লেখযোগ্য নজির নেই। অপরাধের ঘটনা কম দেখবার লক্ষ্যে থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যদ্রূপ মামলা গ্রহণে একপ্রকার ঔদাসীন্য দৃশ্যমান তদ্রূপ ভুক্তভোগী কিংবা তাহার স্বজনদেরও মধ্যে পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা না করিবার প্রবণতা কম নহে। ফলে, পুলিশের পরিসংখ্যান সর্বদা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র তুলিয়া ধরে না।
প্রতিবেদন মতে, গাজীপুরের হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে রাজনীতি, মাদক, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, পূর্বশত্রুতা, জমাজমি, পারিবারিক বিরোধসহ বিবিধ কারণে। অন্যদিকে গাজীপুর চৌরাস্তা, চান্দনা, টঙ্গী, নগরীর বেশ কিছু স্পট অপরাধীদের চিহ্নিত আস্তানা হয়ে উঠলেও পুলিশের পক্ষ হতে জোরালো কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। রাউজানেও আমরা পুলিশের প্রায় অনুরূপ ঔদাসীন্য দেখেছি ।
বলে রাখা প্রয়োজন, রাউজান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা একাধিক সম্পাদকীয় লিখেছি। তথাপি সেখানে স্থানীয় পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি পাবার লক্ষণ দেখা যায় নাই। প্রকৃতপক্ষে, খোদ সরকারেরই মধ্যে যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়, তখন তার প্রভাব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর পড়িতে বাধ্য। গত জুলাই মাসে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং প্রদত্ত বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছিল, বর্তমানে দেশে বৃহদাকার অপরাধের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে না; বরং সর্বাধিক গুরুতর কিছু অপরাধের হার কমেছে কিংবা পূর্বের অবস্থানে রয়েছে।
যদিও উপরে উদ্ধৃত পুলিশেরই পরিসংখ্যান ভিন্ন কথা বলছে। সম্ভবত এই কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, শুধু পরিসংখ্যান দিয়া বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার সুযোগ নাই। জনসাধারণ কতখানি নিরাপদ বোধ করছে অথবা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে, তারও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
গত শনিবার গাজীপুর মহানগরের পুলিশপ্রধান সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি মূলত পুলিশের স্বাভাবিক ধারায় প্রত্যাবর্তন করতে না পারার বিষয়টিকেই উক্ত পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেছেন। কিন্তু এই পুলিশকেই তো আমরা গত কয়েক মাসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আন্দোলন দমনে তৎপর দেখেছি।
শুধু জানমালের নিরাপত্তা বিধানের প্রশ্ন আসলেই যখন তারা দুর্বল হয়ে পড়েন তা হইলে বুঝতে হবে সমস্যাটি অন্যত্র। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার জনজীবনে স্বস্তি ফিরাইতে অঙ্গীকারবব্ধ। অতএব যেই কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে উহার সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশিত। তবে সর্বাগ্রে সরকারকে অপরাধের প্রকৃত চিত্র অস্বীকারের সংস্কৃতি হতে বাহির হতে হবে, যা বস্তুত অতীতের সরকারসমূহের মধ্যে দেখা যেত। সূত্র: সমকাল

