চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আবাসন খাতে দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী শাসনে নতুন কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। বরং পুরোনো প্রকল্প থেকেই নিয়মবহির্ভূতভাবে সংরক্ষিত স্থান ও জলাশয় ভরাট করে প্লট বানিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি, নেতা এবং দলীয় কোটায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের এক বছর পরও সেই অবৈধ প্লটগুলো বাতিল হয়নি। সিডিএর গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনও বহাল আছেন আওয়ামী আমলের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ কারণেই অবৈধ বরাদ্দ বাতিলে কোনো অগ্রগতি নেই।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বন্দরনগরীতে ২৯ হাজার ৭০০ ভবন নির্মিত হয়েছে। এর অধিকাংশই দলীয় নেতা-কর্মী ও সহযোগীদের মালিকানাধীন। ভবন নির্মাণের ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম মানা হয়নি। তিন দফায় মোট ১৫৫টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় দলীয় প্রভাবশালী ও সিডিএ বোর্ড সদস্যদের।
প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ৭ জন মন্ত্রী, ৮ জন এমপি, ১৫ জন আওয়ামী নেতা এবং ১০ জন সাবেক বোর্ড সদস্য। তাদের মধ্যে পলাতক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, সামশুল হক চৌধুরী, এমএ লতিফ, নুরুল ইসলাম বিএসসি, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, দিলীপ বড়ুয়া, মাইন উদ্দিন খান বাদল ও দীপংকর তালুকদারসহ আরও অনেকে আছেন।
২০১৩ সালে সিডিএর ৪০৫তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্তে অনন্যা ও কল্পলোক আবাসিক প্রকল্প থেকে চার ও পাঁচ কাটার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় দলীয় কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন সাবেক বোর্ড সদস্য ও নেতার স্ত্রীদের। তখন এসব এলাকায় প্লট বরাদ্দের সুযোগ ছিল না। পার্ক, খেলার মাঠ, জলাশয় ও কবরস্থান কমিয়ে নকশা পরিবর্তন করে প্লট তৈরি করা হয়। বাজারদরের তুলনায় তিন থেকে ছয়গুণ কম দামে এসব বরাদ্দ হয়।
আওয়ামী আমলে সিডিএ অনুমোদন ছাড়াই একাধিক বহুতল ভবন গড়ে ওঠে। চেরাগী পাহাড় মোড়ে এস আলম গ্রুপের ২২ তলা ভবন তার একটি উদাহরণ। অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও ১৮ তলা পর্যন্ত নির্মাণ শেষে তারা প্ল্যান পাসের আবেদন করে। আবেদন খারিজ হলেও আরও চারতলা নির্মাণ শেষ হয়।
দেওয়ানজী পুকুরপাড়ে হাছান মাহমুদের ২২ তলা ভবন নির্মাণ চলছে। অনুমোদনের কপি নেই। নিয়ম অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভবন সর্বোচ্চ ১৬ তলা, আবাসিক ১২ তলা এবং মিশ্র ভবন ১৪ তলার বেশি হতে পারে না।
জিইসি মোড়ের ও আর নিজাম রোডের আবাসিক এলাকায় সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক হোটেলে রূপান্তর করেন। গোলপাহাড় মোড়ে পলাতক কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন দখলকৃত জমিতে মার্কেট নির্মাণ করেন অনুমতি ছাড়াই।
সিডিএর শীর্ষ ১৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা আছে। অনেকে ১/১১ সরকারের সময় ট্রুথ কমিশনে দুর্নীতি স্বীকার করেছেন। তারপরও তারা বহাল রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে।
গত ৩০ নভেম্বর সিডিএ পরিদর্শনে এসে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “সিডিএতে এখনো ফ্যাসিবাদের ক্ষত রয়ে গেছে। এভাবে এত বড় প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।”
সভায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক আকতার কবির চৌধুরীর মতে, অবৈধ প্লট বাতিল বা অনিয়মে নির্মিত ভবন ভাঙতে এক বছরের বেশি সময় নেওয়ার যৌক্তিকতা নেই। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে সবকিছু রক্ষা করছে।
সিডিএ চেয়ারম্যান নুরুল করিম জানান, মন্ত্রী-এমপিদের অবৈধ প্লটের বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও দুদককে জানানো হয়েছে। নির্দেশনা না পাওয়ায় পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনিক সহায়তা মিললে ভবন ভাঙা হবে। পতিত সরকারের সহযোগী দুর্নীতিবাজদের পদোন্নতি না হলেও দপ্তর পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। নতুন করে যাতে অনিয়ম না হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

