শিল্পনগরী গাজীপুরে বেকারত্বের কারণে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া গার্মেন্ট ও অন্যান্য কারখানার শত শত শ্রমিক কাজ না পেয়ে চুরি, ছিনতাই ও প্রতারণাসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ জানিয়েছে, গত ছয় মাসে মেট্রোপলিটন এলাকা থেকে এক হাজার ৬০০ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আট শতাধিক বেকার শ্রমিক।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বেকারত্ব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এই অপরাধ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। গত এক বছরে জেলায় ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় ৭৩ হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার হয়েছেন। বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টি, মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটাইল ফ্যাশন, ক্লাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলসসহ বিজিএমইএর অন্তর্ভুক্ত বড় ২০টি প্রতিষ্ঠান।
শ্রমিকদের অনেকেই কাজ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন, আবার অনেকে অপরাধের পথে পা বাড়াচ্ছেন। গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান বলেন, “গত ছয় মাসে গ্রেপ্তার হওয়া ১৬০০ ছিনতাইকারীর অর্ধেকই বেকার। আমরা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি, তবে পুলিশের একার পক্ষে সবকিছু করা কঠিন। জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন।” পুলিশ জানিয়েছে, লোকবল ও সরঞ্জামের অভাবে অপরাধ দমনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকায় নজরদারি কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, “বেকারদের জন্য আয়ের সুযোগ তৈরি না করলে অপরাধ বৃদ্ধি পাবে।”
অপরাধের সঙ্গে বেকারত্বের সম্পর্ক জটিল। মাদক কারবারেও বেকাররা প্রবেশ করছে। গাজীপুর মহানগরের বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন জানান, মাদকাসক্ত ‘টোকাই’ গ্যাং এলাকায় দাপট চালাচ্ছে। স্থানীয় রাজনীতিকরাও তাদের ব্যবহার করছেন। নিরাপত্তাহীনতায় গাজীপুরের অনেক বাসিন্দা ঢাকায় বসবাস শুরু করেছেন।
এক সংগীতশিল্পী বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না থাকায় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ঢাকায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তিনি আরও জানান, গাজীপুরে প্রকাশ্যে সাংবাদিকসহ বহু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ মামলায় আসামিরা পরবর্তীতে মুক্ত হয়ে আবার অপরাধে জড়িয়েছে। ২০১৯ সালে লিয়াকত হোসেন নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়, তবে জড়িতদের শাস্তি হয়নি।

গাজীপুরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক ভাসমান মানুষের বসবাস। জনসংখ্যার তুলনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের অপ্রতুলতা এবং মহানগরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিশেষ করে বস্তি এলাকায় অপরাধ বাড়ছে। এর প্রমাণ হিসেবে গত ৭ মাসে গাজীপুর জেলা ও মহানগরে ১০৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে মহানগরে ৪১টি এবং জেলার পাঁচ থানা এলাকা থেকে ৬০টি মামলা দায়ের হয়েছে।
একটি আলোচিত ঘটনা গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ড। গ্রেপ্তারকৃত ছয় আসামির বাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রামে। অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, “গাজীপুরের অপরাধ সমস্যা একক নয়, এটি জটিল সামাজিক সমস্যার প্রতিফলন। শুধু পুলিশের তৎপরতা দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। সমাজের সকল অংশকে মানবিক সমাজ গঠনে কাজ করতে হবে।”
গাজীপুরে বেকারত্ব ও অপরাধ বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে দেখা যায়:
১. কর্মসংস্থান সংকট ও বেকারত্ব:
- গত এক বছরে গাজীপুরে ৭২টি বড় কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
- বন্ধ হওয়া কারখানার কারণে প্রায় ৭৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়েছেন।
- বেকারত্ব বৃদ্ধি পেলে যুবসমাজ আর্থিক সংকটে পড়ে, যার ফলে অনেকেই অপরাধের পথে প্রবেশ করছে।
- গত ছয় মাসে গ্রেপ্তার হওয়া ১৬০০ ছিনতাইকারীর অর্ধেকই বেকার শ্রমিক।
২. অপরাধ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান ও প্রকৃতি:
- চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে গাজীপুর জেলা ও মহানগরে মোট ১০৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।
- গ্রেপ্তারকৃত অনেক অপরাধীর বাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রামে, যা অপরাধের বিস্তার ও সংযোগের চিত্র দেয়।
- অপরাধের মধ্যে ছিনতাই, চুরি, মাদক কারবার ও প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অপরাধ:
- গাজীপুরে রাজনৈতিক দখলদারিত্ব ও অস্থিতিশীলতা রয়েছে।
- কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী পেছন থেকে নৈরাজ্যের জন্য সক্রিয়, যা অপরাধকে উৎসাহিত করছে।
- মাদকাসক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আশ্রয় অপরাধ বেড়েছে।
৪. আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা:
- পুলিশের লোকবল ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।
- পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য না থাকায় কার্যকর নজরদারি করা সম্ভব হচ্ছে না।
- ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি এলাকাগুলো অপরাধ বৃদ্ধির জন্য শরণস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- পুলিশ এককভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম নয়, জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন।
৫. সামাজিক ও জনমানসিক প্রভাব:
- নিরাপত্তাহীনতার কারণে গাজীপুরের বাসিন্দারা আতঙ্কিত।
- অনেকেই বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে যাচ্ছেন।
- সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়, অনীহা এবং নিরাপত্তার প্রতি অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- প্রকাশ্যে হত্যা এবং অপরাধের ঘটনা দেখে জনগণ প্রতিবাদের সাহস হারাচ্ছে।
৬. অপরাধ ও বেকারত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক:
- বেকারত্ব ও অপরাধ বৃদ্ধির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
- আর্থিক সমস্যায় পড়া যুবসমাজ অপরাধকে বিকল্প জীবিকা হিসেবে দেখে।
- অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে।
৭. মাদক ও সন্ত্রাসের বিস্তার:
- মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গাজীপুরে দাপট চালাচ্ছে।
- মাদকাসক্ত ‘টোকাই’ গ্যাং এলাকায় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ছিনতাই, হানাহানি ও অশান্তি সৃষ্টি করছে।
- স্থানীয় রাজনীতিকদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।
বেকারত্ব বৃদ্ধির উদ্বেগজনক চিত্র : গত এক বছরে গাজীপুরে ৭২টি বড় কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর ১৩টি কারখানা, মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন লিমিটেড, টেক্সটাইল ফ্যাশন, ক্লাসিক ফ্যাশন ও লা-মুনি অ্যাপারেলসসহ বিজিএমইএভুক্ত বড় ২০টি প্রতিষ্ঠান। এই বন্ধের ফলে প্রায় ৭৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়েছেন। অর্থনৈতিক মন্দা, বাজারের হ্রাস ও পরিচালন খরচ বৃদ্ধির কারণে এই বন্ধের ঘটনা ঘটেছে। বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণে শ্রমিকরা আর্থিক সংকটে পড়েছে, যা তাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করছে।
সাম্প্রতিক অপরাধ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান: গত ছয় মাসে গাজীপুর মহানগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৬০০ ছিনতাইকারী, যাদের অর্ধেকই বেকার শ্রমিক। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে জেলা ও মহানগরে ১০৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গ্রেপ্তারকৃত অপরাধীদের বাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রামে, যা অপরাধের বিস্তার ও জালের ইঙ্গিত দেয়। অপরাধের মধ্যে ছিনতাই, হত্যা, মাদক কারবার, প্রতারণা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য।

অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে অপরাধ প্রবণতার বৃদ্ধি: গাজীপুরে রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অস্থিতিশীলতা রয়েছে। পেছন থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠী নৈরাজ্যের জন্য কাজ করছে। মাদকাসক্ত ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আশ্রয় অপরাধ বৃদ্ধি করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পুলিশ কার্যকরভাবে কাজ করতে পারছে না, যার ফলে অপরাধীরা নিরাপদে অপরাধ চালাচ্ছে।
আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা: পুলিশের লোকবল ও সরঞ্জামের অভাব অপরাধ দমন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। গাজীপুরের ঘনবসতিপূর্ণ ও বস্তি এলাকাগুলোতে অপরাধ দ্রুত বিস্তার পাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা এবং জনসাধারণের অবহেলা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
অপরাধ হ্রাসে নতুন প্রস্তাবনা ও কৌশল:
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি: বেকারদের জন্য দ্রুত নতুন কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: রাজনৈতিক দল ও প্রশাসন মিলে অস্থিতিশীলতা রোধে কাজ করতে হবে।
- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী: পুলিশ বাহিনীর লোকবল ও সরঞ্জাম বৃদ্ধি করতে হবে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
- সামাজিক সচেতনতা: যুবসমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- জনগণের সহযোগিতা: অপরাধ দমনে জনসাধারণের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
- মাদক ও সন্ত্রাস দমন: মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নির্মূল করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
- আদালত ও বিচার ব্যবস্থা: অপরাধীদের দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
গাজীপুরের বেকারত্ব ও অপরাধ বৃদ্ধির সমস্যা জটিল ও বহুমাত্রিক। শুধুমাত্র পুলিশের কঠোর পদক্ষেপ বা প্রশাসনিক উদ্যোগে এটি মোকাবেলা সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সচেতনতা ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ কঠিন। সময়ের প্রয়োজনে সকল স্তরের সংশ্লিষ্টদের একযোগে কাজ করা একান্ত প্রয়োজন।

