দেশের রেল ও সড়ক খাতে গত সাড়ে ১৫ বছরে তিনটি প্রতিষ্ঠান লুটপাটের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। সারা দেশের সরকারি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। এর বড় অংশ নিয়েছে তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স নামের দুই প্রতিষ্ঠান। এই দুই প্রতিষ্ঠান রেলের ৮০ শতাংশ এবং সড়কের ২৫ শতাংশ কাজ দখল করেছে। নেপথ্যে ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজম, যিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত।
তিনজন মিলে সরকারি টেন্ডারে একপ্রকার মাফিয়া রাজত্ব চালিয়েছেন। টেন্ডারের শর্ত এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে শুধু ম্যাক্স ও তমা প্রতিষ্ঠানই অংশ নিতে পারে। তারা ভাগাভাগি করে কাজ নিতো। প্রাক্কলিত মূল্য বারবার বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছিল। এ টেন্ডার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল মির্জা আজমের হাতে। তিনি ওই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব মতে, রেল ও সড়ক খাতে যে উন্নয়ন কাজ হয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশ অর্থ লুটপাট হয়েছে। এই টাকা তিনজনের পকেটে গিয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশজুড়ে অপকর্ম ও দুর্নীতি বেড়েছে। সরকারের পতনের পর এ বিষয়গুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কিভাবে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন এই সিন্ডিকেট।
রেলের দখলদারিত্ব ছিল এদের সবচেয়ে বড় রাজত্ব। গত সাড়ে ১৫ বছরে তারা রেলের একচ্ছত্র ব্যবসা চালিয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির কর্ণধাররা, যাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক ও গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর, রেলের ‘কালো বিড়াল’ হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা অন্তত ৭০ হাজার কোটি টাকার কাজ নিয়েছে। রেলের উচ্চ পদে নিজেদের লোক বসিয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। কাজ পাওয়ার পর প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বারবার বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে।
আলোচিত প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তারা বিদেশ থেকে আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে যন্ত্রপাতি পাচার করেছে। মির্জা আজম এসব লুটপাটের ‘গডফাদার’ ছিলেন। তিনি প্রভাব খাটিয়ে তাদের অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি ঘটেছে। এখানে মাটি ভরাটের কাজে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার লোপাটের অভিযোগ আছে। প্রকল্পের জন্য ৫ লাখ ৮৮ হাজার ঘনমিটার মাটি দরকার ছিল যা পরবর্তীতে ১১ লাখ ঘনমিটার করা হয়। মাটির দামও অনেক বেড়ে গেছে। প্রকল্প পরিচালকদের ওপর চাপ দিয়ে অনেককে বদলি ও ওএসডি করা হয়েছে।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেল প্রকল্পে ২০১৬ সালে খরচ ধরা হয়েছিল ১৮৩৪ কোটি টাকা। তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অনেক গুণ। প্রকল্প শেষে সেখানে মাত্র তিনটি ট্রেন চলাচল করছে, যেখানে ২৪-২৮টি ট্রেন চলার কথা ছিল। রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার রেললাইন প্রকল্পে ২০১০ সালে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে, কিন্তু ২০১৮ সালে শেষ হয়। খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকায়। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর রেললাইন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৯৮৩ কোটি থেকে ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা হয়েছে। প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই।
এই সব প্রকল্পে তমা ও ম্যাক্স প্রতিষ্ঠানগুলো মদদ পেয়েছে মির্জা আজমের সহযোগিতায়। তারা নিজস্ব পরিকল্পনা নিয়ে মন্ত্রিসভা ও সচিবালয়ে অনুমোদন করাতেন। প্রকল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য চীনসহ অন্যান্য দেশের প্রতিষ্ঠানের নামে জয়েন্ট ভেঞ্চার গড়ে তুলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে ছিল।
মির্জা আজম নিজেই মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রকল্প পরিচালক বদলি করতেন এবং অবাধ লুণ্ঠনের পথ সুগম করতেন। প্রকৌশলীদের ওপর নানা চাপ ও হয়রানি ছিল। যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাদের বদলি বা ওএসডি করা হতো। এভাবেই গত সাড়ে ১৫ বছরে রেল বিভাগে লুটপাট ও মাফিয়া শাসন কায়েম ছিল।

