বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা একসময় নদী, চরাঞ্চল, কৃষি ও বৈচিত্র্যময় প্রাণপ্রবাহে সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু আজ এই জেলা ভয়াবহ পরিবেশ সংকটে পড়েছে। পানি, মাটি, বায়ু ও জীববৈচিত্র্য—সবই এখন দূষণের করাল গ্রাসে।
দূষণের বড় কারণ নদীভাঙন, বালু উত্তোলন, প্লাস্টিক বর্জ্য, কৃষিজ রাসায়নিক এবং দ্রুত বেড়ে যাওয়া ইটভাটা শিল্প। অথচ এই ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সচেতনতা উদ্বেগজনকভাবে কম।
গাইবান্ধায় অনুমোদিত ও অননুমোদিত মিলে বর্তমানে ২৫০টির বেশি ইটভাটা চলছে। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মে পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে এগুলো সক্রিয় থাকে। অধিকাংশই পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯) ভঙ্গ করছে।
বেশির ভাগ ভাটা বসতি এলাকা, বিদ্যালয় ও কৃষিজমির কাছাকাছি। নির্ধারিত চিমনি উচ্চতা মানা হয় না, আধুনিক প্রযুক্তি (জিগজ্যাগ কিলন বা হাইব্রিড হফম্যান) ব্যবহারও হয় না। পুরোনো পদ্ধতিতে ইট পোড়ানোয় প্রতি মৌসুমে বিপুল পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, কালো ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম ধূলিকণা বায়ুমণ্ডলে ছড়ায়।
ইটভাটার জন্য আশপাশের জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়া হয়, যা জমিকে অনাবাদি করে তোলে। এতে কৃষি উৎপাদন কমে যায় এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। ধোঁয়া ও ধুলাবালি বায়ুদূষণ বাড়ায়, যা বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য মারাত্মক। দীর্ঘমেয়াদে এটি হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যান্সার ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
ইট পোড়াতে কাঠ ও কয়লা ব্যবহারে প্রতিবছর বহু গাছ কেটে ফেলা হয়। ফলে বনজ সম্পদ হারায়, পাখি ও বন্যপ্রাণীর আবাস নষ্ট হয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। নদীর ধারে বসানো ভাটা থেকে বালু ও মাটি সহজে সংগ্রহ করা হয়, যা নদীভাঙন ত্বরান্বিত করে এবং চরাঞ্চলের প্রতিবেশ ধ্বংস করে। বর্ষায় ভাটার রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে গিয়ে জলদূষণ ঘটায়।
আইন অনুযায়ী ইটভাটা স্কুল, আবাসিক এলাকা ও কৃষিজমি থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকার কথা। কিন্তু গাইবান্ধার বেশির ভাগ ভাটা এই নিয়ম ভঙ্গ করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরদারি অপ্রতুল, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অনিয়মিত। প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন অনেক ভাটা আইনের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
শহরের ভেতরে আরেক বিপর্যয় আবর্জনার স্তূপ। গলি থেকে শুরু করে জেলা কারাগারের মূল ফটক পর্যন্ত দুর্গন্ধে ভরা। গাইবান্ধা থেকে পলাশবাড়ী যাওয়ার পথে ময়লার চিত্র আমিনবাজারের স্তূপের কথা মনে করিয়ে দেয়।
প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা অনেক সময় এসব দেখেও না দেখার ভান করেন। অনিয়ন্ত্রিত স্লুইসগেট, বাঁধ ও অবৈধ স্থাপনা নদী-খালের প্রবেশমুখ বন্ধ করে দিয়েছে। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জল এত দূষিত যে দেখলেই খাওয়ার ইচ্ছা নষ্ট হয়।
পরিবেশ নিয়ে সচেতন মানুষ অসহায় বোধ করেন, প্রবীণরা স্মৃতিচারণে মগ্ন হন। অথচ প্রকৃতির এই সম্ভাবনাময় জেলা সঠিক পরিকল্পনায় সাজানো গেলে হতে পারত পরিপাটি শহর ও উৎকৃষ্ট বাসস্থান।

