সম্প্রতি গণপিটুনিতে মানুষের মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শহর ও গ্রাম—প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। অভিযোগের সত্যতা থাকুক বা না থাকুক, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারবে না। এই ঘটনাগুলো সামাজিক শান্তি ও মানুষের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন নিজের হাতে নেওয়ার প্রবণতা সমাজকে অস্থির করছে। প্রতিদিন গণপিটুনির শিকার মানুষ সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে এবং ন্যায্য বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমাচ্ছে।
শুধু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয়, সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। অভিযোগ থাকলে তা আইনের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। গণপিটুনি বন্ধ করতে সামাজিক সচেতনতা, দ্রুত তদন্ত এবং সঠিক শাস্তি অপরিহার্য।
রংপুরের তারাগঞ্জে রবিদাশ সম্প্রদায়ের রূপলাল নামের এক ব্যক্তি আত্মীয়কে নিয়ে মেয়ের বিয়ের বিষয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন ভ্যানে করে। পথিমধ্যে একদল লোক তাঁদের বিরুদ্ধে ভ্যান চুরির অভিযোগ এনে পিটিয়ে হত্যা করে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, আক্রান্ত দুই ব্যক্তি হাতজোড় করে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন। তারপরও তাঁরা গণপিটুনির হাত থেকে রেহাই পাননি।
রংপুরের গণপিটুনির রেশ না কাটতেই গত রোববার রাতে মাগুরা সদরে চোর সন্দেহে যুবক সজল মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করেন স্থানীয় লোকজন। গাজীপুরের টঙ্গীতে গণপিটুনিতে আরেক যুবক নিহত হয়েছেন। রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় হাসিবুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে রোববার মামলার আসামি ওয়াজেদ আলীকে পিটিয়ে হত্যা করেন প্রতিপক্ষের লোকজন। মধ্যযুগে দাঁতের বদলে দাঁত, প্রাণের বদলে প্রাণ নেওয়ার রীতি চালু ছিল। তাহলে আমরা কি সেই অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছি?
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত দেশে অন্তত ১১১ নাগরিক গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ১০ দিনে দেশে অন্তত ১৩টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯ জন, আহত হয়েছেন আরও ১৩ জন।
দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি ও সেনাসদস্যরাও নিয়োজিত। তারপরও একের পর মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে কীভাবে? যে দেশে আইনের শাসন থাকে, সে দেশে গণপিটুনি ও মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটতে পারে না। তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ ফারুক বলেছেন, তাঁরা ঘটনাস্থলে গেলেও মব ডিঙিয়ে আক্রান্ত দুই লোককে বাঁচাতে পারেননি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ হলো দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আক্রান্ত, দুর্বল ও অসহায় মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। এখন তারাই যদি দুর্বৃত্তদের ভয়ে কম্পমান থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, যখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি বেড়ে যায়, তখন মানুষও মানুষের প্রতি সহিংস হয়ে ওঠে। অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তাৎক্ষণিক মব ও দলবদ্ধ মবের ঘটনা ঘটছে। দলবদ্ধ মবের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকুক আর না–ই থাকুক, আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন দেশে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছিল। বিস্ময়কর হলো, তখনো মব সন্ত্রাস ও গণপিটুনিতে এত মানুষ মারা যায়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাদক ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে বন্দুকযুদ্ধে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সেটাও জনজীবনে মারাত্মক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অন্য রকম ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। গোষ্ঠীবিশেষ হীন রাজনৈতিক স্বার্থ কিংবা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিল করতে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। কিন্তু সরকার এদের বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এটাও সমাজে আরেক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে।
গত শতকের সত্তরের দশকে গণপিটুনির প্রাদুর্ভাব দেখে সাংবাদিক নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।’ এরপর বাংলাদেশে কত সরকার এল, কত সরকার গেল, কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি মানুষ পেল না। সূত্র: প্রথম আলো

