ধলাই নদী থেকে লুট হওয়া সাদা পাথর সিলেটের ভোলাগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে মজুত হয়েছে। যদিও অনেক পাথর ইতিমধ্যেই ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের কাছ থেকে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে, কিছু পাথর এখনো নদীর চরে রয়েছে। কেউ কেউ পাথর মজুত করেছেন ক্রাশার কারখানার আঙিনায়।
গতকাল বুধবার ভোলাগঞ্জ ও ধলাই নদীর আশপাশ এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। সাদা পাথর লুটের ঘটনায় সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী রোববারের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া, পাথর লুটের নেপথ্যের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গতকাল ভোলাগঞ্জ এলাকায় পরিদর্শন করেছে দুদক সিলেট সমন্বিত কার্যালয়ের একটি দল।
দুদকের উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাত বলেন, “আমরা মূলত পাথর লুটের নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করব।” সিলেট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানান, “সাদা পাথর নিয়ে বৈঠক হচ্ছে। তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে।”
নদী থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকলেও অনেককে আগের লুট হওয়া পাথর সরাতে দেখা গেছে। ধলাই নদীতীর কালাইরাগে পাথর সরানোর সময় জেলা প্রশাসনের অভিযানকারী দলের উপস্থিতি টের পেয়ে এক ট্রাক্টর চালক ও পাথরের মালিক পালিয়ে যান। পরে ট্রাক্টর ও কিছু যন্ত্রপাতি ধ্বংস করা হয়। প্রশাসন ওই এলাকা থেকে ১২ হাজার ফুট পাথর জব্দ করেছে। অভিযানকারী দলের নেতৃত্বে থাকা জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মাহমুদ আশিক কবির পাথর লুটের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

শ্রমিকদের কাছ থেকে পাথর কিনে ধলাই নদীর চরের দয়ারবাজার ও কালাসাদেক এলাকায় অন্তত ৩০ স্থানে স্তূপ করা হয়েছে। ভোলাগঞ্জের পাড়ুয়া এলাকার প্রমি ক্রাশার মিল, তুহিন ক্রাশার মিল, লাকি স্টোন ক্রাশার, হেপি স্টোন ক্রাশার, ইমরান ও ডিজিটাল স্টোন ক্রাশার এবং সিলেট সদরের ধোপাগুল এলাকার আমিন স্টোন, মাইশা, সিলেট স্টোন ক্রাশারসহ কয়েকটি কারখানায় পাথর মজুত থাকতে দেখা গেছে। তবে ক্রাশার মালিকরা এসব পাথর ভোলাগঞ্জের নয় বলে দাবি করেছেন। মাইশা স্টোন ক্রাশার মিলের মালিক মামুন তালুকদার বলেন, “সাদা পাথর অনেক কারখানায় ক্রাশিং হয়। এখন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্রাশিং বন্ধ রয়েছে।”
গতকাল বিকেলে ট্রাকবোঝাই পাথর নিয়ে ভোলাগঞ্জ থেকে ফেনী শহরে যাচ্ছিলেন চালক হৃদয়। তিনি দাবি করেন, এগুলো ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর নয়, এলসি পাথর। বিমানবন্দরের পাশে শহরে প্রবেশের অপেক্ষায় ওই সময় বেশ কিছু ট্রাক দেখা গেছে। চালকরা দয়ারবাজারের বাসিন্দা নুরুল জানান, মজুত করা পাথর রাতের আঁধারে কৌশলে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ সিলেটের বাইরে, কেউ স্থানীয় কারখানায় বিক্রি করছেন।
অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। গতকাল বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। বাপা বলেন, “দুষ্কৃতকারীরা শুধু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যই ধ্বংস করছে না, তারা পর্যটনকেন্দ্র ও স্থানীয় অর্থনীতি ও হাজারো মানুষের জীবিকাও নষ্ট করছে। এটি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”

মানববন্ধনে বাপা-সিলেটের সভাপতি জামিল আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক কাসমির রেজা, এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম, ইকবাল সিদ্দিকী, মোজাক্কির হোসেন কামালী, ভাস্কর রঞ্জন দাস ও অধ্যাপক ড. শাহাদাত চৌধুরী।
২০১৭ সালে ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এক বছর ধরে পাথর লুট চলেছে। শুধু সাদা পাথর নয়, ধ্বংস হয়েছে পাশের রেলের ‘বাঙ্কার’ এলাকা। পর্যটনকেন্দ্রের পূর্ব-দক্ষিণ দিকে বিভিন্ন স্থান থেকে মাটি খুঁড়ে পাথর লুটের ঘটনায় সম্প্রতি দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিন ভয়েসের মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসকারী কার্যক্রম বন্ধ ও শাস্তির দাবি জানানো হয়। ছাত্র ও নেতাকর্মীরা প্রতীকী প্ল্যাকার্ডে লিখেছে, ‘প্রকৃতি চুরি চলবে না, চোরের ক্ষমা হবে না’, ‘সাদা পাথর আমাদের সম্পদ, রক্ষা করো, লুট নয়’, ‘সাদা পাথরে কালো হাত’।
মৌলভীবাজারের বিজ্ঞান আন্দোলন মঞ্চও প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছে। গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাবের সামনে অবৈধ সাদা পাথর উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রতিবাদে এবং জড়িতদের শাস্তি দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন রাজিব সূত্রধর, মাধুরী মজুমদার, রেহনোমা রুবাইয়াৎ, বিশ্বজিৎ নন্দী প্রমুখ।

