সিলেটের ভোলাগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নজরকাড়া স্থান। পাহাড়ি ঢাল, বড় ও ছোট পাথর, মধ্যবর্তী জলধারা—সব মিলিয়ে পর্যটকেরা সেখানে বসে ছবি তুলতেন, প্রাকৃতিক দৃশ্যের আনন্দ নিতেন। তবে চার মাস ধরে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত। সাদাপাথরের পাথরগুলো কেবল লুট হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততায় দিনদুপুরে অবৈধ উত্তোলন চলেছে। স্থানীয় প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, তবে তা যথেষ্ট ছিল না। এর ফলে পাথর লুট ঠেকানো যায়নি এবং পর্যটনকেন্দ্রের পূর্বের আকর্ষণ হারিয়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যেখানে আগে বড়-বড় পাথর ছিল, সেখানে এখন গর্ত। প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর লুট হয়ে গেছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সাদাপাথরের সৌন্দর্যহানি অর্থনৈতিক ক্ষতি ও পর্যটন ব্যবসায় প্রভাব ফেলেছে। হাসান মিয়া নামে এক যুবক জানান, ঘোড়ায় পর্যটকদের চড়িয়ে দৈনিক তিনি আগে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করতেন; এখন আয় নেমে ৪০০–৫০০ টাকায়। তার পরিবারের খরচ চালানো কঠিন হয়ে গেছে।
পাথর লুটের পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকার বিষয়টি পরিবেশকর্মীরা প্রাধান্য দিয়ে দেখেছেন। পরিবেশবাদী সংগঠন “ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)”–এর সিলেট সদস্যসচিব আবদুল করিম চৌধুরী প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে জানান, পাথর লুটে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। প্রকাশ্য ও গোপনে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব লুটপাটকে উৎসাহিত করেছে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা পাথর উত্তোলনের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, যা দুঃখজনক।

সাদাপাথর ও অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রিক এলাকা যেমন জাফলং, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়া ইত্যাদিতে পাথর আসে সীমান্তের ওপারের ভারতের পাহাড়ি নদী থেকে। দীর্ঘদিন ধরে পানির স্রোতের সঙ্গে পাথর সমাহিত হয়ে কোয়ারি তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালের আগে সংরক্ষিত এলাকা বাদে সিলেটের আটটি কোয়ারি ইজারা দিয়ে পাথর উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। কিন্তু পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির কারণে ২০২০ সালের পর ইজারা বন্ধ করা হয়।
এতেও রাজনৈতিক নেতারা কোয়ারি চালুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় কিছু নেতা রাতের আঁধারে পাথর ও বালু লুট করতেন। এরপর স্থানীয় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের নিয়ন্ত্রণে কোয়ারি আসার পর গণলুট শুরু হয়। পরিবেশকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, প্রকাশ্যে লুটে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা জড়িত।
স্থানীয় প্রশাসনও পাথর উত্তোলনের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী ৯ জুলাই এক সভায় বলেন, “সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা হলে সিলেটে কেন নয়? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত।” এই ধরনের মন্তব্য স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। প্রশাসনকে অসক্রিয় বা অপ্রতুল বলে অভিযোগ উঠেছে।
সিলেটের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা সকলেই পাথর উত্তোলনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। গত কয়েক বছরে তাঁরা পাথর কোয়ারি ইজারা পুনঃচালুর চেষ্টা করেছেন। তবে সরকার অনুমতি দেয়নি। ২০২৪ সালের ২৭ এপ্রিল দেশের ৫১টির মধ্যে ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে আটটি সিলেটের। সংরক্ষিত এলাকা ও পর্যটনকেন্দ্রের পাথর একসঙ্গে লুট হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

মানববন্ধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা পাথর কোয়ারি চালুর দাবিতে সমর্থন দেখিয়েছেন। সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, জামায়াত মহানগরের আমির মো. ফখরুল ইসলাম, জেলা সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন এবং এনসিপি সিলেট জেলা সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগরের প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মো. খায়রুল ইসলাম এই মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন।
স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে কিছু কার্যক্রম দেখা গেলেও, লুটপাট অব্যাহত ছিল। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নার বলেন, “ক্যাপাসিটি অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, কিন্তু অভিযান শেষে ফিরে এলেই আবার লুটপাট শুরু করে দেয় চক্রটি।”
সাদাপাথর এলাকায় লুটপাটের ঘটনায় বিভিন্ন নেতা ও কর্মীদের নাম এসেছে। বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য দলের অন্তত ৩৫ জন নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন, কেউ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, বিপুল পরিমাণ পাথর লুট হয়েছে—তার পেছনে রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাবশীলদের সহায়তা ছিল।
পাথর উত্তোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য হাজি কামাল, উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি লাল মিয়া, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে দুদু, জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল আহমদ বাহার, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ এবং আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিন উল্লেখযোগ্য। জাফলংয়ে পাথর লুটপাটে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরানের নামও এসেছে।
পাথর পরিবহন ও ক্রাশার মেশিনের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। এসব মেশিনের মালিকদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে সব পক্ষই পাথর উত্তোলনের পক্ষে। পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ ও বিজিবি অভিযান চালিয়েছে, কিন্তু কার্যকরভাবে লুট রোধ করা সম্ভব হয়নি।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে নেমেছে। পাঁচ সদস্যের দল সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পাথর ব্যবসায়ী জড়িত ছিল। জেলা প্রশাসন তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদ্মা সেন সিংহকে আহ্বায়ক করা হয়েছে।
পাথর লুটের কারণে পর্যটন ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে। দৈনিক ৪–৫ হাজার পর্যটক আসা সাদাপাথরে এখন সংখ্যা কমে গেছে। হোটেল, দোকান ও ঘোড়ায় চড়া থেকে আয় কমেছে। সাদাপাথরের প্রাকৃতিক ভারসাম্যও ভাঙার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলেন, “পাথর রাতারাতি পুনরায় আসবে না। অল্প সময়ে সব পাথর নিয়ে যাওয়ায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে। পর্যটকরা ঘোলা পানি ও বালু দেখবে, আগের অবস্থা ফিরবে না।”
এ ঘটনায় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকার জটিলতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দখল, ব্যবসা, স্থানীয় প্রশাসনের ঘাটতি—সব মিলিয়ে সাদাপাথরে গণলুটের বিষয়টি গভীর এবং বহুমাত্রিক সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
পাথর লুট, পর্যটন ব্যবসায় ক্ষতি, রাজনৈতিক নেতাদের জড়িততা এবং প্রশাসনের কার্যকারিতা—এই চারটি বিষয় সাদাপাথরের সমস্যা সমাধানের প্রধান চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সাদাপাথর আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পেতে হলে, সমন্বিত উদ্যোগ, আইনগত ব্যবস্থা এবং কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

