জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট বিগত সরকারের সময়ের প্রভাবশালী ৫৪ জেলা প্রশাসক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ১৫৯ কোটি টাকার কর ফাঁকির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে, অনেক পরিবারের সদস্যরাও অনৈতিকভাবে আয় কর ফাঁকি দিয়েছেন।
আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জেলা প্রশাসক ও তাদের পরিবারের গত ১০ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন খতিয়ে দেখা হয়েছে। এখন তাদের বিরুদ্ধে রাজস্ব আইনে মামলা করা হবে। সরকারি অনুমতি নিয়ে এদের জব্দযোগ্য সম্পদ হিসাব জব্দ করা হবে। অনেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা করার বিষয়েও আলোচনা চলছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সরকারদলীয় প্রার্থীদের জেতাতে জড়িত ছিলেন এসব জেলা প্রশাসক। তারা অনেক প্রার্থীকে জেতানোর অঙ্গীকার করে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। এসব অনৈতিক আয় আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৫৪ জেলা প্রশাসক বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছেন। ঘুষ নেওয়া এবং অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে। অযোগ্য ব্যক্তিদের সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছেন। অবৈধভাবে আয় করা অর্থ দিয়ে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সরকারি তহবিল থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে তারা ফ্ল্যাট, প্লট, জমি এবং বাণিজ্যিক ভবন কিনেছেন। এছাড়া পাচারের অর্থ বিদেশেও রেখেছেন। তদন্তে দেখা গেছে, এসব ব্যক্তির সন্তানরা বিদেশের ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছে। টিউশন ফি বছরে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া জীবনযাপনের ব্যয়ও রয়েছে। শিক্ষার্থীর নামে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এসব তথ্য আয়কর রিটার্নে উল্লেখ হয়নি।
তাদের বিদেশি ভ্রমণ ঘনঘন হয়েছে। একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যা রিটার্নে দেখানো হয়নি। অনেকের একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগও আছে। এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘এনবিআরের কাছে সব করদাতা সম্মানিত। তবে কেউ কর ফাঁকি দিলে ছাড় দেওয়া হবে না। বিগত সরকারের সময়ে অনেকে বড় ধরনের দুর্নীতি করেছেন। প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ চেয়ারম্যানের নির্দেশে ৫৪ জেলা প্রশাসক ও তাদের পরিবারের কর ফাঁকির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে। আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট মূলত কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্ত করে।
ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন মাদারীপুরের মো. ওয়াহিদুল ইসলাম, হবিগঞ্জের মাহমুদুল কবীর মুরাদ, ঢাকার আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান, নারায়ণগঞ্জের রাব্বী মিয়া, শেরপুরের আনার কলি মাহবুব, সিলেটের এম কাজী এমদাদুল ইসলাম, ফেনীর মো. ওয়াহিদুজ্জামান, নোয়াখালীর তন্ময় দাস, কুমিল্লার মো. আবুল ফজল মীর, নেত্রকোনার মঈন উল ইসলাম, ময়মনসিংহের ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, জামালপুরের আহমেদ কবীর, সুনামগঞ্জের মোহাম্মদ আবদুল আহাদ, মৌলভীবাজারের মো. তোফায়েল ইসলাম, মুন্সীগঞ্জের সায়লা ফারজানা, মানিকগঞ্জের এস এম ফেরদৌস, কিশোরগঞ্জের মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী, রাঙামাটির এ কে এম মামুনুর রশিদ, টাঙ্গাইলের মো. শহীদুল ইসলাম, নরসিংদীর সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন, শরীয়তপুরের মো. কাজী আবু তালেব, ফরিদপুরের উম্মে সালমা তানজিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ জেড এম নুরুল হক, গোপালগঞ্জের মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার।
রাজবাড়ীর মো. শওকত আলী, চট্টগ্রামের মো. ইলিয়াস হোসেন, বান্দরবানের মো. দাউদুল ইসলাম, খাগড়াছড়ির মো. শহিদুল ইসলাম, কক্সবাজারের মো. কামাল হোসেন, নাটোরের মো. শাহরিয়াজ, লক্ষ্মীপুরের অঞ্জন চন্দ্র পাল, চাঁদপুরের মো. মাজেদুর রহমান খান, সিরাজগঞ্জের কামরুন নাহার সিদ্দীকা, বগুড়ার ফয়েজ আহমেদ, রাজশাহীর এস এম আব্দুল কাদের, বাগেরহাটের তপন কুমার বিশ্বাস, নওগাঁর মো. মিজানুর রহমান, পাবনার জসিম উদ্দিন, জয়পুরহাটের মো. জাকির হোসেন, খুলনার মো. হেলাল হোসেন, সাতক্ষীরার এস এম মোস্তফা কামাল, কুষ্টিয়ার মো. আসলাম হোসেন, মাগুরার মো. আলী আকবর, বরগুনার কবীর মাহমুদ, ভোলার মো. মাসুদ আলম ছিদ্দীক, রংপুরের এনামুল হাবীব, চুয়াডাঙ্গার গোপাল চন্দ্র নাথ, ঝিনাইদহের সরোজ কুমার নাথ, নড়াইলের আনজুমান আরা, মেহেরপুরের মো. আতাউল গনি, বরিশালের এস এম অজিয়র রহমান, ঝালকাঠির মো. হামিদুল হক, পিরোজপুরের আবু আহমেদ সিদ্দিকী, পটুয়াখালীর মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী। বর্তমানে তাঁরা ওএসডি হিসেবে আছেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এসব ডিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ আসে। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, এনবিআর আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট এবং সিআইডিসহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ জমা পড়ে।

