অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্মগুলো এখন দেশের গ্রামাঞ্চলে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বেটিংয়ের নেশায় বুঁদ তরুণরা। সাকিব আল হাসান, নুসরাত ফারিয়ার মতো তারকারা কখনও কখনও এসব সাইটের প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় এসব সাইটের সন্ধান মিলেছে পর্নোগ্রাফিক সাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে।
বেকার তরুণ আসিফের কাহিনি:
বরগুনার বেকার আসিফ ভেবেছিলেন ভাগ্য খুলে গেছে। ডিজিটাল বাজি ও অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে তিনি দিনে প্রায় এক হাজার টাকা আয় করতে শুরু করেন—একজন বেকারের জন্য বড় অঙ্ক। প্রথম সাফল্যের পরে আসিফ আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছ থেকে আরও টাকা জোগাড় করেন। সেই টাকা ঢেলে দেন একের পর এক বেটিং সাইটে। তিনি আশা করতেন ভাগ্যের চাকা এবার ঘুরে যাবে।
কিন্তু যখন বিনিয়োগ ও আয় বড় হতে শুরু করে, টাকাটা তুলে নেওয়া সম্ভব হয়নি। উল্টো, সাইটের পরিচালনাকারীরা আরও টাকা দাবি করতে শুরু করেন। আসিফ তখন তাদের ফাঁদে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। তিনি বলেন, “আমি টাকা ঢালছিলাম, আর অ্যাপে দেখাচ্ছিল হাজার হাজার টাকা জিতেছি। কিন্তু টাকাটা তুলতে গেলে বললো আরও বিনিয়োগ করতে হবে। সেটাও করেছি। কিন্তু সেই টাকা আর কখনো পাইনি। অন্যান্য গেমেও হাজার হাজার টাকা হারিয়েছি।”
শেষপর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ টাকা হারিয়ে দেন আসিফ । ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে, অনলাইন জুয়ার নেশা আরও গভীর হয়। জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। আসিফ বলেন, “আমার জীবন এখন দুর্বিষহ। বের হওয়ার পথ জানি না।”আসিফের মতো ডিজিটাল বেটিংয়ের আসক্তি গ্রামে আরও অনেক তরুণের মধ্যে দেখা গেছে। তারা জানান, এলাকার তরুণদের বেশিরভাগই এখন অনলাইন বাজির নেশায় বুঁদ।

বেটিং সাইটের ফাঁদ:
ওয়ানএক্সবেট, মেলবেট, নগদএইটিএইট, ক্রিকেক্স, জিতবাজ, বেটউইনার, টুয়েন্টিটুবেট, মোস্টবেট, বেটজিলি—এই ধরনের অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্মগুলো বিদেশি সার্ভার ব্যবহার করে অবৈধভাবে পরিচালিত হয়। এগুলো গেমিং বা স্পোর্টস অ্যাপ বলে প্রচারণা চালায়। ভুয়া জয়, পাতানো গেম এবং টাকা তোলার মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবহারকারীকে ফাঁদে ফেলে। গ্রামের তরুণদের ডিজিটাল স্বাক্ষরতার অভাব ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাজে লাগিয়ে তারা লাভ করে।
বাংলা ইন্টারফেস ও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে তরুণদের ঋণ ও আসক্তির চক্রে আটকে রাখা হয়। শুরুতে অল্প আয়ের সুযোগ দেখানো হয়। কিন্তু কদিনের মধ্যে টাকা তোলার পথ বন্ধ হয়ে যায় বা আরও জমা দেওয়ার চাপ দেওয়া হয়। গ্রামের যুবকদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তারা মূলত সোশ্যাল মিডিয়া বা পর্নোগ্রাফিক সাইটের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জুয়ার সাইটের সঙ্গে পরিচিত হয়।
রাজবাড়ীর আমিনুল বলেন, “আমি অনলাইন বিজ্ঞাপন দেখে জুয়ার জগতে ঢুকেছি। আমার মাধ্যমে অনেক বন্ধুও যোগ দিয়েছে। আমার পরিচিতদের ৯০ শতাংশেরও বেশি এখন অনলাইন জুয়ায় আসক্ত।” বছরের পর বছর ধরে অনেক নামীদামী তারকাও এসব প্ল্যাটফর্মের প্রচারণায় ব্যবহার হয়েছেন। কয়েক মাস আগে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে একটি বেটিং প্ল্যাটফর্মের প্রচারণামূলক গানে দেখা গিয়েছিল। ওই প্ল্যাটফর্মের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, নুসরাত ফারিয়া তাদের অফিশিয়াল ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।

ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকেও একাধিকবার বেটিং বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে। গত বছর একটি ভারতীয় বেটিং কেলেঙ্কারির সময় তার বোনের নামও বিনিয়োগকারীর তালিকায় উঠে আসে। অনেক ইউটিউবারও কাস্টমাইজড রেফারেল কোড ব্যবহার করে বেটিং প্রচারণা চালান। কোড ব্যবহার করে নতুন কেউ যোগ দিলে, রেফার করা এবং নতুন ব্যবহারকারী—দুটোই বোনাস পান। এভাবেই গ্রামে নতুন ব্যবহারকারীদের টেনে আনা হয়। গ্রামাঞ্চলে কেউ বন্ধুর মাধ্যমে বা চাচাতো ভাই, প্রতিবেশীর হাত ধরে এই জগতে প্রবেশ করে। এভাবে অনলাইন বেটিং ছড়িয়ে পড়ছে।
গ্রামের তরুণদের ডিজিটাল আসক্তি :
২০২৪ সালের একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে, দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। এই প্রাপ্তবয়স্কদের ওয়েবসাইটগুলোতে নিয়মিত অনলাইন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। ফলে এক বিশাল জনসংখ্যা এক ক্লিকেই বেটিং প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করছে। একসময় যা ছিল শহুরে জীবনের সীমাবদ্ধতা, এখন সেই স্মার্টফোন ব্যবহার গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষত কিশোর ও তরুণদের মধ্যে। গ্রামের যে যুবকরা একসময় খোলা মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলতে দেখা যেত, এখন তাদের বিকেল কাটে রাস্তার ধারের টং দোকান বা চায়ের স্টলে। মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখে তারা অধিকাংশ সময় অনলাইন গেম ও বেটিংয়ে মনোনিবেশ করছে।
জার্নাল অব পাবলিক হেলথ ইন বাংলাদেশে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, দেশের গ্রামে প্রাক-স্কুলগামী শিশুদের অর্ধেকের বেশি ইতিমধ্যেই স্মার্টফোনে আসক্ত। অর্থাৎ, খুব অল্প বয়স থেকে ডিজিটাল-নির্ভরতা গড়ে উঠছে। এই আচরণগত পরিবর্তনের ফলে শারীরিক কার্যকলাপ কমেছে এবং তারা ডিজিটাল জুয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মুখোমুখি হচ্ছে। গবেষকরা এটিকে একটি বৃহত্তর ডিজিটাল আসক্তি সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর পেছনে রয়েছে সস্তা স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং গ্রামের অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব।

শহর ও গ্রামের তরুণদের মধ্যে ডিজিটাল স্বাক্ষরতার ব্যবধানও গুরুত্বপূর্ণ। শহরের যুবকরা হয়তো অনলাইন প্রতারণা চেনার বিষয়ে সতর্ক, কিন্তু গ্রামের কিশোরদের প্রায়শই সেই জ্ঞান নেই। ফলে তারা প্রতারক জুয়ার অ্যাপ ও ভুয়া ওয়েবসাইটের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায়। জনপ্রিয় বেটিং ওয়েবসাইটের অনেক নকল সংস্করণ রয়েছে, যেগুলোকে ফিশিং সাইটও বলা হয়। প্রথম দৃষ্টিতে এই সাইটগুলো আসল প্ল্যাটফর্মের মতোই দেখায়। ডিজাইন, লেআউট, এমনকি নামও প্রায় একই থাকে। একমাত্র পার্থক্য থাকে ডোমেইনের শেষে, যেমন ‘.com’ vs ‘.io’, ‘.vip’ বা ‘.pro’। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অল্প অভিজ্ঞ ব্যবহারকারীরা এই পার্থক্য ধরতে পারে না। ফলে তারা নকল সাইটে টাকা বিনিয়োগ করেন এবং পুরো টাকাই চলে যায় প্রতারকের পকেটে।
আমিনুল জানান, “এসব নকল সাইটে আমি হাজার হাজার টাকা হারিয়েছি। আসল আর নকলের পার্থক্য করা খুব কঠিন।” বেটিং সাইটে সাধারণত বিভিন্ন গেমের আয়োজন থাকে। খেলতে প্রথমে টাকা জমা দিতে হয় এবং জিতলে নগদ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জেতা টাকা ব্যবহারকারীর হাতে পৌঁছায় না। সাইটগুলো টাকা তোলার প্রক্রিয়া আটকে দিতে নানা অজুহাত দেখায়। কেউ যদি বড় অঙ্কের জিতলে, দেখানো হয় কৃত্রিম ত্রুটি বা সিস্টেমের সমস্যা। এসব প্ল্যাটফর্মে সাধারণত মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করা হয়। ফলে টাকা লেনদেন সহজ হলেও, প্রতারণার ফাঁদও কার্যকর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “অনলাইন জুয়া শুরু অনেকেই শুধু সময় কাটানোর জন্য করে, কিন্তু ধীরে ধীরে এটি মানসিক নির্ভরতায় রূপ নেয়। এমন পরিস্থিতিতে দিনে অন্তত একবার না খেললে তারা স্বস্তি পান না। জুয়ায় আসক্ত হয়ে মানুষ নিজের, পরিবারের ও সম্পর্কের দায়িত্ব ভুলে যায়। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনাতেও অবহেলা শুরু করে।”
ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, ডিজিটাল জুয়ার বিস্তার রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নেপথ্যের নেটওয়ার্কগুলো ধ্বংস করা এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়, বরং এটি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। “একজন আসক্ত ব্যক্তি আর্থিকভাবে ধ্বংস হতে পারে, সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে, একাকিত্ব ও হতাশায় ভুগতে পারে। সামাজিক জীবন বলতে কিছু থাকে না। তারা যদি আসক্তি থেকে বের হতে না পারেন, রাষ্ট্রের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে।”
অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইন:
গ্রামে অনলাইন জুয়া নীরবে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো বিধিবিধান বা যথাযথ আইনি সুরক্ষা না থাকায় যুবকরা হাজার হাজার থেকে লাখ লাখ টাকা হারাচ্ছেন। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, ভুক্তভোগীদের মানসিক স্থিতি ও পারিবারিক সম্পর্কও বিপন্ন হচ্ছে।
আইন আছে, তবে প্রয়োগের জটিলতা ও ডিজিটাল বাস্তবতা চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ২০ ধারা অনুযায়ী, জুয়ায় অংশ নেওয়া বা এর প্রচারণা করা ফৌজদারি অপরাধ। এই ধারার আওতায় অনলাইন জুয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে।
আইনি বাধা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন বেটিং ও জুয়া দেশের গ্রামাঞ্চলে ত্বরিত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ডিজিটাল বিপদ মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) শাহাদাত হোসেন জানান, সাইবার মনিটরিং ইউনিট এই ধরনের প্ল্যাটফর্মের প্রচারকারী পেজ ও অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে নিয়মিত আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে।
শাহাদাত হোসেন আরও বলেন, অবৈধ অনলাইন জুয়া পরিবার, তরুণ প্রজন্ম এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ হুমকি। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকা এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, “গ্রামে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা একে ডিজিটাল আসক্তিতে রূপ দিয়েছে। অনলাইন জুয়ায় অংশ নেওয়া, প্রচারণা চালানো বা এজেন্ট হিসেবে কাজ করা—সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সহায়তায় আমরা সন্দেহজনক ওয়েবসাইট ও অ্যাপ ব্লক ও বন্ধ করতেও কাজ করছি।”
এ অবস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো: আইন থাকলেও প্রযুক্তিগত জটিলতা, ভুয়া সাইটের হুড়োহুড়ি, এবং জনসচেতনতার অভাব। তাই শুধু শাস্তি নয়, জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ তরুণদের নিরাপদ ডিজিটাল ব্যবহারের বিষয়টিও জরুরি।
অনলাইন জুয়া শুধু অর্থের ক্ষতি নয়, এটি তরুণদের মানসিক ও সামাজিক জীবনেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। গ্রামের যুবকরা সহজলভ্য স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের কারণে ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। বিদ্যমান আইন থাকলেও প্রযুক্তিগত জটিলতা, ভুয়া সাইট এবং সচেতনতার অভাব সমস্যা বাড়াচ্ছে। তাই শাস্তি ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের যৌথ প্রচেষ্টাই পারে ডিজিটাল জুয়ার ভয়াবহ প্রভাব কমিয়ে তরুণদের নিরাপদ ও সৃজনশীল পথে ফিরিয়ে আনতে।

