রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় রাত গভীর হলে জমে ওঠে গোপন আড্ডা। বাইরে থেকে ক্যাফে বা লাউঞ্জ মনে হলেও ভেতরে এগুলো রূপ নেয় সিসা বারে। সেখানে তামাকজাত সিসার সঙ্গে ব্যবহার হয় নানা ধরনের মাদক। অনেক জায়গায় চলে অনৈতিক কার্যক্রমও। অথচ দেশে সিসা বার পরিচালনার কোনো বৈধ অনুমতি নেই। আইন স্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা দিলেও কার্যকর তদারকির অভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে চলেছে এ সংস্কৃতি।
সম্প্রতি বনানীতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা এই অবৈধ ব্যবসার চিত্র আরো স্পষ্ট করেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ‘৩৬০ ডিগ্রি’ নামের একটি সিসা বার থেকে বের হয়ে খুন হন ইন্টারনেট ব্যবসায়ী রাহাত হোসেন রাব্বি (৩১)। তদন্তে জানা গেছে, এর আগেও ওই স্থানে ‘এরাবিয়ান কজি’ নামে সিসা বার চালু ছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে তা বন্ধ হয়। কিন্তু মালিকপক্ষ নাম পাল্টে আবারও একই ধরনের ব্যবসা শুরু করে। অভিযানের পরও এভাবে বারবার গোপনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বাংলাদেশে সিসা বা হুক্কা কোনোভাবেই বৈধ নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এ বিষয়ে অনুমতি দেয় না। তবুও রাজধানীতে একশোর বেশি সিসা বার চালু আছে। এর মধ্যে অন্তত ৫০টি তরুণ-তরুণীদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এ আসর। উচ্চ শব্দে বাজে সংগীত, ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে থাকে অ্যালকোহলের গন্ধ। অনেক সময় সিসার সঙ্গে মেশানো হয় ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল কিংবা লিকুইড কোকেন।
শুধু মাদক নয়, রাজধানীর অনেক সিসা বারে তৈরি করা হয়েছে আলাদা কেবিন। বাইরে থেকে সাধারণ বসার জায়গার মতো মনে হলেও ভেতরে থাকে সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ। নির্দিষ্ট গ্রাহকেরাই সেখানে প্রবেশাধিকার পান। ঘণ্টাভিত্তিক ভাড়া নিয়ে কেবিনে সরবরাহ করা হয় সিসা, অ্যালকোহল ও অন্যান্য মাদক। এর সঙ্গে চলে যৌন কার্যক্রমও। প্রতিবেদকের হাতে আসা এক ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, রাজধানীর একটি সিসা বারের কেবিনে কয়েকজন যুবক-যুবতী মাদক সেবনের পর অনৈতিক সম্পর্কে জড়াচ্ছেন। পরিচয়পত্র যাচাইয়ের নিয়ম নেই বরং অতিরিক্ত অর্থে ‘প্রাইভেট সেশন’ বুক করলেই সব ব্যবস্থা করে দেয় কর্মচারীরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সিসা বার এখন শুধু ধূমপানের জায়গা নয়, এটি মাদক, যৌন ব্যবসা ও অপরাধী নেটওয়ার্কের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিকভাবে দেখা যায়- অনেক দেশে সিসা বৈধ হলেও কঠোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সিসা ক্যাফে চালাতে হলে সরকারি লাইসেন্স নিতে হয়, স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক। কাতারে অনুমোদিত হোটেল ছাড়া সিসা পরিবেশন করা যায় না। সৌদি আরবে লাইসেন্স ছাড়া সিসা সরবরাহ করলে ফৌজদারি মামলা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে কোনো লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষই নেই। আইন স্পষ্ট থাকলেও নেই নিয়মিত পরিদর্শন। ফলে রাজধানী থেকে পর্যটনকেন্দ্র পর্যন্ত সিসা বার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিস্তার লাভ করছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেহেদী হাসান বলেন- বাংলাদেশে সিসা বার চালানোর কোনো বৈধ অনুমতি নেই। অবৈধভাবে পরিচালনা করলে অভিযান চালিয়ে সেগুলো বন্ধ করা হয়, সরঞ্জাম জব্দ হয় এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তরুণদের মধ্যে সিসার আসক্তি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহজেই জড়িয়ে পড়ছে। এক অভিভাবক জানান, তার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে ক্যাফেতে যাওয়ার কথা বলে রাতে ফিরলেও পরে জানা যায় সে সিসা ও মদে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন- এ ধরনের আসক্তি তরুণদের হতাশা, আত্মহত্যাপ্রবণতা ও মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়। মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, তরুণ প্রজন্ম সিসাকে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক মনে করছে। এই ভুল ধারণা থেকে তারা নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। শুধু উচ্চবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত পরিবারও এ ফাঁদে পড়ছে। তিনি মনে করেন, সচেতনতা ও প্রচারণার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
অভিজাত এলাকার স্থানীয়দের অভিযোগ- এসব সিসা বারের অবস্থান ও পরিচালনাকারীদের পরিচয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অজানা নয়। অনেক সময় তারা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। অভিযান হলেও তা সাময়িক, ফলে মালিকরা আবার ব্যবসা চালু করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. আল আমিন হোসাইন বলেন, সিসা বার বন্ধের দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হলেও অবৈধ কার্যক্রম চললে পুলিশও অভিযান চালায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানী ড. তৌহিদুল হক বলেন, কর্তৃপক্ষ সিসা বার নিয়ে ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ অবস্থায় আছে। দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ না নিলে এগুলো মাদক ও গ্যাং কালচারের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠবে।

