একজন আসামির বিষয়ে তদন্ত করে পাওয়া গেছে, তিনি মাথায় গুলি করে অন্তত এক হাজার ৩০ জনকে হত্যা করেছেন। ভিকটিমদের গুম করে রাখা হতো কুখ্যাত আয়নাঘরে। এরপর হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নৌকায় তুলে মাঝ বুড়িগঙ্গায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো। খুনি নিজেই স্বীকার করেছে, মাথার কাছে গুলি করার পর রক্ত আর মগজের ছিটা হাতে লাগলে তার ভেতরে এক ধরনের উন্মাদ উল্লাস কাজ করত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের এই বক্তব্যের সূত্র ধরে আমার দেশ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। জানা গেছে, এই সিরিয়াল কিলার আর কেউ নন, বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত র্যাবে দায়িত্ব পালনকালে নিজের টিম নিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করেছেন তিনি। ‘গলফ করো’ ছিল তার কোডওয়ার্ড, অর্থাৎ কাউকে খুন করার নির্দেশ।
বর্তমানে জিয়াউল আহসান কেরানীগঞ্জের বিশেষ কারাগারের ধলেশ্বরী ভবনে ডিভিশনপ্রাপ্ত সেলে বন্দি। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনি মোট ১৫টি মামলায় কারাবন্দি, যার মধ্যে হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, জিয়াউল আহসান ছিলেন শেখ হাসিনা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত। তাদের নির্দেশে তিনি গুম-খুন চালাতেন। ভিকটিমদের আয়নাঘরে আটকে রেখে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ গুম করা হতো। কখনো নদীতে ফেলে দেওয়া, কখনো রেললাইনে রেখে ট্রেন দিয়ে দ্বিখণ্ডিত বা ত্রিখণ্ডিত করা হতো। কমলাপুর থেকে টঙ্গি পর্যন্ত রেললাইনে যে অজ্ঞাত লাশগুলো পাওয়া যেত, তার বড় অংশই ছিল জিয়াউল আহসানের দলের খুন করা মানুষ।
বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী ছিল তার নৃশংসতার প্রধান সাক্ষী। নির্দিষ্ট নৌকায় করে যমটুপি পরা বন্দিদের নিয়ে যেতেন মাঝনদীতে। সেখানে চোখ বাঁধা অবস্থায় মাথার কাছ থেকে গুলি করে নদীতে ফেলে দিতেন। কখনো লাশ সিমেন্টভর্তি বস্তা দিয়ে বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার পেছনেও জিয়াউল আহসানের হাত রয়েছে বলে জানা গেছে।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর কাছে মানুষ হস্তান্তরের ঘটনাতেও তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সিলেট সীমান্ত দিয়ে অন্তত সাতজনকে তুলে দেওয়ার প্রমাণ রয়েছে। এছাড়া তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লেনদেন ও আর্থিক সুবিধা গ্রহণের কথাও উঠে এসেছে।
সেনা জীবনে জিয়াউল আহসান ছিলেন ২৪তম লং কোর্সের কর্মকর্তা (আইডি: বিএ-৪০৬০)। র্যাব-২ এ যোগদানের পর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা প্রধান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরে এনএসআই ও এনটিএমসির পরিচালক হন। ২০২১ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতির পর এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হেফাজতের শাপলা চত্বরের গণঅভিযান, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনসহ বহু আলোচিত ঘটনায় তার নাম উঠে আসে। গুম কমিশনের রিপোর্টেও দেখা গেছে, গুমের বেশিরভাগ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে তার টিম। কমিশনের মতে, শেখ হাসিনা ছিলেন ‘সুপিরিয়র কমান্ড’, যিনি তারিক সিদ্দিকের মাধ্যমে গুম-খুনের নির্দেশ দিতেন।
অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোন আড়িপাতা—সবকিছুতেই তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়ার লেখায়ও তার ভয়ঙ্কর অপরাধের উল্লেখ আছে। ফলে শেখ হাসিনার শাসনকালে জিয়াউল আহসান হয়ে উঠেছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক।
গত পনেরো বছরে বাংলাদেশে ব্যাপক হারে গুমের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন রাষ্ট্রের পাঁচটি বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কমিশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোট গুমের ৬০ শতাংশে র্যাবের কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন।
গত ৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমে জড়িত ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাদের মধ্যে ছয়জন উচ্চপদস্থ সাবেক কর্মকর্তা। পাঁচজনই ডিজিএফআইর সাবেক মহাপরিচালক ও পরিচালক। তারা হলেন- লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লে. জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) তৌহিদুল ইসলাম।
২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার বিচারপতি মইনুল ইসলামের নেতৃত্বে গুম তদন্ত কমিশন গঠন করে। কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনা অনুসন্ধান করার। ইতোমধ্যে কমিশন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ : অ্যা স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে দুটি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরে চূড়ান্ত রিপোর্ট সরকারকে হস্তান্তর করা হবে।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গুম করা হতো তিনটি ধাপে-
- প্রথম ধাপে ছিল ‘কৌশলগত নেতৃত্ব’। এ পর্যায়ে ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক ও পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
- দ্বিতীয় ধাপে ছিলেন বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চিহ্নিত কর্মকর্তারা।
- তৃতীয় ধাপে ছিলেন মাঠপর্যায়ের সদস্যরা, যারা ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন।
কমিশন জানায়, তারা গুমের এক হাজার ৮৫০টি অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে ৩৪৫ জন এখনও নিখোঁজ। ভিকটিম পরিবারের অনেকেই অভিযোগ দায়ের করার পরও হুমকি পাচ্ছেন। কমিশনের হাতে এসব হুমকির প্রমাণও রয়েছে। তদন্তে আরও জানা গেছে, জিয়াউল আহসানসহ অন্তত ২৩ জন কমান্ডার গুম ও খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত।
সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া তার ফেসবুক পোস্টে র্যাবের কর্মকাণ্ড এবং জিয়াউল আহসানের ভূমিকা নিয়ে বিশদভাবে লিখেছেন। তিনি বলেন, র্যাবে প্রেষণে যাওয়া তরুণ অফিসাররা ফিরে আসতেন পেশাদার খুনির মতো মানসিকতা নিয়ে। এই প্রবণতা শুধু অফিসার নয়, জেসিও, এনসিও ও সাধারণ সৈনিকদের মধ্যেও দেখা গেছে।
ইকবাল করিম ভূঁইয়া উল্লেখ করেন, র্যাব থেকে ক্রসফায়ারের ঘটনা বন্ধে তিনি চেষ্টা করেছিলেন। একসময় এডিজি কর্নেল মুজিব তাকে আশ্বস্তও করেন। কিছুদিন নতুন কোনো ক্রসফায়ারের খবর না আসায় স্বস্তি পেলেও পরে জানতে পারেন ঘটনাগুলো গোপন রাখা হচ্ছে।
র্যাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কর্নেল জিয়াউল আহসান হয়ে ওঠেন আরও উচ্ছৃঙ্খল। তিনি নিজের বাসায় গার্ড মোতায়েন, অস্ত্র মজুত ও সিসিটিভি বসিয়ে সামরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। সাবেক সেনাপ্রধানের ভাষায়, তার আচরণ ছিল এমন যেন “মস্তিষ্ক পাথর বা ইটের টুকরো দিয়ে ঠাসা।”
ইকবাল করিম ভূঁইয়া আরও জানান, সেনানিবাসের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জিয়াউল আহসানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক ও সামরিক সচিবদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে তিনি অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম ভঙ্গ করে প্রভাব খাটাতেন।
বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ১৫ জন সিরিয়াল কিলারের মধ্যে সর্বোচ্চ হত্যার সংখ্যা ৩০০ জন পর্যন্ত। সাধারণত যে ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে তিন বা ততোধিক মানুষ হত্যা করে মানসিক তৃপ্তি পায়, তাকে পুলিশি পরিভাষায় ‘সিরিয়াল কিলার’ বলা হয়। তাদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো খুনের প্রতি অস্বাভাবিক আসক্তি।
তবে সেই ভয়ংকর পরিসংখ্যানকেও ছাড়িয়ে গেছেন বাংলাদেশের সাবেক সেনা কর্মকর্তা বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, জিয়াউল আহসান অন্তত ১ হাজার ৩০ জনকে গুম ও খুন করেছেন অমানবিক নৃশংসতায়। এর আগে দেশে খুলনার এরশাদ শিকদার এবং চাঁদপুরের রসুখাঁর কাহিনি জনমনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু জিয়াউল আহসানের কাহিনি তাদেরকেও ম্লান করে দিয়েছে।
খুনের পাশাপাশি জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও ঘুষের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগও উঠেছে। সূত্র জানায়, তার স্ত্রী নুসরাত জাহান এবং তার নামে-বেনামে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এ কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ২৪ জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
তদন্তে জানা গেছে- তাদের ১২টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩৪২ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। এছাড়া জিয়াউল আহসান অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডার নাগরিকত্ব নিয়ে সেদেশে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি দুবাই, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রেও বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।
দুদক সূত্র আরও জানিয়েছে, জিয়াউল আহসানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস ইনোভেশন লিমিটেড’-এর নামে একটি ব্যাংক হিসাবে ২৭ কোটি ১০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এছাড়া ‘এআই ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’ ও ‘এআই ল্যান্ডস্কেপ লিমিটেড’-এর নামে ২৫ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্যও পাওয়া গেছে।

