বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড গঠিত তিন সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিটি সম্প্রতি একাদশ বিপিএলে স্পট ফিক্সিং সংক্রান্ত তদন্ত শেষ করেছে। তদন্তকাজের অডিও রেকর্ডিং ৩০০ ঘণ্টার মতো, যার লিখিত রূপ তিন হাজার পৃষ্ঠার বেশি। প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরির কাজও সম্পন্ন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কমিটি এই রিপোর্ট বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলামের কাছে জমা দেবে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সাবেক বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের স্বাধীন কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার কমিটির সভাপতি। অন্য দুই সদস্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. খালেদ এইচ চৌধুরী এবং সাবেক ক্রিকেটার শাকিল কাসেম।

প্রাথমিক ও চূড়ান্ত রিপোর্ট:
ড. খালেদ এইচ চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রাথমিক রিপোর্ট মূলত আসন্ন বিপিএলকে সামনে রেখে তৈরি। এর লক্ষ্য—ফ্র্যাঞ্চাইজি বাছাই ও খেলোয়াড় ড্রাফটের ক্ষেত্রে বিসিবিকে সতর্ক করা এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া। তিনি বলেন, “প্রাথমিক রিপোর্টে আমরা আমাদের মূল পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ উল্লেখ করব। কেন এসব হচ্ছে, কীভাবে বন্ধ করা যাবে, ফ্র্যাঞ্চাইজি কাঠামো কেমন হওয়া উচিত—এসব তুলে ধরব।” চূড়ান্ত রিপোর্ট আগামী মাসে প্রকাশ হবে। এতে সর্বশেষ বিপিএলে সন্দেহজনক ঘটনা ও অভিযুক্তদের বিস্তারিত তথ্য থাকবে। তবে কমিটি মনে করছে, বিষয়টিতে আরও তদন্ত প্রয়োজন।
অভিযুক্ত ও সুপারিশ:
গত বিপিএলে (২০২৪–২৫) ৩৬টি সন্দেহজনক ঘটনা ঘটেছে। প্রাথমিক তদন্তে ১০–১২ জন ক্রিকেটারের নাম এসেছে, যাদের মধ্যে ৩–৪ জন ‘হাই ফ্ল্যাগড’—অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশ নিশ্চিত। এদের মধ্যে দুইজন জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার (একজন পেসার, একজন অফ স্পিনার) এবং একজন পেসার রয়েছেন, যিনি বিপিএলে অস্বাভাবিক ওয়াইড খেলেছেন।
অন্যরা ‘মিডিয়াম ফ্ল্যাগড’ ও ‘লো ফ্ল্যাগড’—যাঁদের বিরুদ্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে রিপোর্টে ‘নির্দোষ’ বলা হবে না। অভিযুক্তদের বেশির ভাগ বয়স ৩৫ এর বেশি, ফলে জাতীয় দলে ফেরার সম্ভাবনা কম। তবে হাই ফ্ল্যাগড না হলেও শ্রীলঙ্কা সফরের একজন খেলোয়াড় এবং একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির কোচের নাম তালিকায় আছে। কমিটি তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজির ওপর নিশ্চিত—দুর্বার রাজশাহী, সিলেট স্ট্রাইকার্স ও ঢাকা ক্যাপিটালস স্পট ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত। অধিকতর তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের বিসিবির কার্যক্রম থেকে দূরে রাখার সুপারিশ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সম্প্রচারক ও বেটিং এজেন্ট:
টেলিভিশন চ্যানেল ও সম্প্রচারকদের নিয়েও তদন্তে পর্যবেক্ষণ আছে। বিশেষ করে অনলাইন বেটিং বিজ্ঞাপন প্রচার করা চ্যানেলগুলো স্পট ফিক্সিংয়ের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকতে পারে। এক চ্যানেল শুধু বিজ্ঞাপন প্রচার করেই ১৭০–১৮০ কোটি টাকা আয় করেছে। সন্দেহভাজন এজেন্টরা প্রায়ই স্টেডিয়ামের করপোরেট বক্সে দায়িত্বশীলদের পৃষ্ঠপোষকতায় খেলা দেখেছে। বিদেশ থেকে আসা এজেন্টদের নিরাপত্তা, থাকা ও যাতায়াতও এখান থেকে ব্যবস্থা করা হয়। তবে এখন অনেক বেটিং প্রতিষ্ঠান স্থানীয় এজেন্টও ব্যবহার করছে।
পূর্ববর্তী আসরের ঘটনা ও সুপারিশ:
যদিও কমিটি মূলত সর্বশেষ বিপিএলের ঘটনা তদন্ত করেছে, তবে গত পাঁচ আসরের ১৪০টির বেশি সন্দেহজনক ঘটনা ধরা পড়েছে। ৬০-এর বেশি স্থানীয় ও বিদেশি খেলোয়াড়ের নাম এসেছে, কারও কারও বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ।
কমিটি সুপারিশ করবে, বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে সক্রিয় রাখা হোক জাতীয় ক্রিকেট লিগ, প্রিমিয়ার লিগসহ সব আসরে। এছাড়া অনলাইন বেটিং নিয়ন্ত্রণে আইন সংস্কার বা নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাব থাকবে, যাতে বিসিবি নিজেই আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। ফরেনসিক তদন্তের জন্যও সুপারিশ থাকবে। সম্প্রতি ইউনিটের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন আইসিসির সাবেক কর্মকর্তা অ্যালেক্স মার্শাল।

তদন্তে উঠে এসেছে, বিপিএলের ঘরোয়া ক্রিকেটের স্বচ্ছতা ও সুনামের জন্য এখন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। প্রাথমিক রিপোর্টের মাধ্যমে বিসিবি জানছে কোথায় ফাঁকফোকর রয়েছে এবং কীভাবে আসন্ন আসরে সতর্ক থাকতে হবে। চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হলে স্পট ফিক্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত খেলোয়াড়, ফ্র্যাঞ্চাইজি ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেয়া সম্ভব হবে।
এটি শুধু প্রতিযোগিতার মান রক্ষা করবে না, দর্শক ও বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসও পুনঃস্থাপন করবে। প্রতিবেদনটি বিসিবিকে সতর্ক করবে, দোষীদের শনাক্ত করবে এবং ভবিষ্যতে বিপিএলকে আরও স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য করার পথ দেখাবে।

