সরকারের কড়া অভিযান, প্রশাসনের একের পর এক ঘোষণার পরও সিলেট অঞ্চলে অবৈধ পাথর উত্তোলন থামছে না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও বিস্তৃত আকার নিচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেটের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ও বন্ধ থাকা কোয়ারিগুলোতে দিনরাত পাথর তোলা হচ্ছে। নদীর তীরে জমা করে রাখা এসব পাথর হাজার হাজার শ্রমিক টুকরো টুকরো করে বাল্কহেডে তুলছেন। আবার কোথাও ব্যবহার করা হচ্ছে ভারী খননযন্ত্র। সবকিছু যেন চলছে প্রশাসনের চোখের সামনেই।
২০২০ সালে পাথর উত্তোলনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এর পর থেকে লুটেরা চক্র কৌশল পাল্টায়। নিলামে বিক্রি হওয়া বৈধ পাথর সরানোর সুযোগকে তারা অবৈধ লুটপাটের ঢাল বানায়। প্রশাসনের শিথিল নজরদারির সুযোগে প্রতিদিন কোয়ারি থেকে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর লুট হয়ে যাচ্ছে। এসব অপকর্মে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকরা। শুধু তাই নয়, প্রশাসনের নীরবতাকেও অনেকে এই লুটের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন।
অভিযোগ রয়েছে- স্থানীয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দলের নেতারা এই অবৈধ পাথর ব্যবসায় সক্রিয়ভাবে জড়িত। পাশাপাশি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর নামও শোনা যাচ্ছে। আদর্শগতভাবে যারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা পাথর লুটের ক্ষেত্রে যেন একই মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন। পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বিষয়ে বলেন, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর লুটের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন হয় এই চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করেছে, না হয় নীরব থেকেছে। হয়তো দুটোই ঘটেছে।
সংবাদমাধ্যমে রাতের আঁধারে ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে পাথর লুটের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর সরকার বিশেষ অভিযান চালায়। কিন্তু এ অভিযান কার্যকর হয়নি। কারণ একদিকে রাতের বেলা লুট হওয়া পাথর আবার কোয়ারিতে ফিরিয়ে আনা হয়, অন্যদিকে দিনে চলে নিয়মিত উত্তোলনের মহড়া। এতে বোঝা যায়, অভিযান কেবল দেখানোর জন্যই হয়।
প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী- ২০২০ সালে কোয়ারি ইজারা বন্ধ হওয়ার পর ভ্রাম্যমাণ আদালত নদীর দুই পাড় ও আশপাশের এলাকা থেকে প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করে। এর মধ্যে ৪৪ লাখ ঘনফুট একই বছর নিলামে তোলা হয়।
নিলামে পাথর কিনেছিলেন স্থানীয় ঠিকাদার কামরুল হাসান চৌধুরী। তিনি একসময় সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সক্রিয় নেতা ছিলেন। অভিযোগ আছে, তাঁকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ২০ থেকে ৩০ জন নেতাকর্মী পাথর লুটে জড়িত। আবার বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারাও প্রকাশ্যে এই লুটপাটকে সমর্থন করেছেন, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়কারী শাহ সাহেদা আখতার বলেন, নিলামের বৈধ কাগজকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী চক্র নির্বিচারে কোয়ারি থেকে পাথর লুট করছে। ফলে বৈধতার আড়ালে অবৈধ ব্যবসা চলছেই।
ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে অবৈধ পাথর উত্তোলনের ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় দেড় হাজার জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে এত বিপুল সংখ্যক আসামির বিচার কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, বাস্তবে ধরা পড়ে কেবল দিনমজুর শ্রমিকরা। এরা মালিকের হয়ে কাজ করা সাধারণ মানুষ। অথচ পাথর লুটের মূল পরিকল্পনাকারী ও পৃষ্ঠপোষকেরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।
পরিবেশবিদেরা বলছেন- প্রশাসনের পদক্ষেপ কেবল লোক দেখানো। যখনই সংবাদমাধ্যমে আলোচনার ঝড় ওঠে, তখনই প্রশাসন অল্প কিছুদিন সক্রিয় হয়। পরে আবার সব আগের মতো চলে। একদিকে অভিযানের ঘোষণা, অন্যদিকে চলমান লুট—এই দ্বিচারিতা পরিবেশ ও সমাজ উভয়ের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর।
সিলেট অঞ্চলের নদী ও পাহাড় থেকে এভাবে নির্বিচারে পাথর উত্তোলনের ফলে মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হচ্ছে, পানির স্তর কমছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের জীবিকাও হুমকির মুখে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ পাথর উত্তোলন শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্যই নষ্ট করছে না বরং স্থানীয় অর্থনীতিতেও অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে।
বিশ্লেষকদের দাবি- অবৈধ পাথর উত্তোলন রোধ করতে হলে কেবল শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করলেই হবে না। বরং এর নেপথ্যের কুশীলব, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ও প্রশাসনের অসাধু অংশকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নাহলে যত অভিযানই চালানো হোক, এই চক্রকে রুখে দেওয়া সম্ভব হবে না।

