গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানো ২৭ অস্ত্রধারী এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। এই সবাই যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মী। পুলিশের প্রদর্শিত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে পিস্তল, শটগান ও কাটা বন্দুক। এক বছর পার হলেও হামলায় ব্যবহৃত মাত্র দুটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
গত বছরের ১৬ ও ১৮ জুলাই এবং ৪ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরে আন্দোলনকারী ছাত্রদের সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ ঘটে। মুরাদপুর, বহদ্দারহাট ও নিউমার্কেট এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে হামলা চালানো হয়। ঘটনার ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে পুলিশ ৪৬ অস্ত্রধারী শনাক্ত করে। এর মধ্যে ১৯ জনকে র্যাব-পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, ১৬ জুলাই মুরাদপুরে পিস্তল হাতে ছিলেন যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী। তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কাটাবন্দুক হাতে ছিলেন তালিকাভুক্ত যুবলীগ নেতা মো. ফিরোজ, যিনি নিজেকে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। শটগান হাতে ছিলেন নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সংগঠক মো. দেলোয়ার। পিস্তল হাতে ধরা পড়েছেন যুবলীগ কর্মী এন এইচ মিঠু ও মো. জাফর। তারা নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিমের অনুসারী। নুরুল আজিমও মুরাদপুরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মাহমুদা বেগম বলেছেন, ‘অস্ত্রগুলো হাতবদল হওয়ায় উদ্ধার করতে সময় লাগছে। অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত আছে।’ এদের মধ্যে শুধু মো. ফিরোজকে গত বছরের ২৪ অক্টোবর র্যাব গ্রেপ্তার করেছে। অন্যরা এখনো পলাতক। হেলাল আকবর চৌধুরীসহ কিছু পলাতক অস্ত্রধারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও সক্রিয়। মুরাদপুরে গুলিবর্ষণকারীদের মধ্যে আহনাফ নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী এবং চকবাজার ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিঠুন চক্রবর্তীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ঘটনার সময় তাঁদের হাতে থাকা পিস্তল উদ্ধার করা যায়নি।
নগরের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট এলাকায় ১৮ জুলাই পিস্তল হাতে ধরা পড়েন স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন ফরহাদ, যুবলীগ কর্মী মো. জালাল ওরফে ড্রিল জালাল, মো. জামাল, ঋভু মজুমদার ও মো. মিজান। শটগান হাতে ছিলেন যুবলীগ কর্মী মো. তৌহিদ। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এই অস্ত্রধারীরা সবাই নগরের ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. এসরালের অনুসারী। এসরাল আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তৌহিদুল, মিজান, জামাল ও ঋভু মজুমদারকে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানি ওয়ান শুটারগান নিয়ে তৌহিদুল একাই ছাত্রদের ওপর ২৮টি গুলি চালিয়েছেন।
এদিকে, গত বছরের ৪ আগস্ট নিউমার্কেট, সিআরবি ও আসকার দিঘির পাড় এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষে প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহৃত হয়। মুখে মাস্ক, হাতে শটগান নিয়ে গুলি করেছেন মো. শামীম। তিনি যুবলীগ ক্যাডার হিসেবে নগরে পরিচিত। ওই ঘটনায় সিআরবি এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সাইফুল ইসলাম ও মো. হাসান। প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছেন মোস্তফা কামাল ও ইকবাল হোসেন। তারা সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম ওরফে বাহাদুরের অনুসারী।

একই দিন জামাল খান ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের নেতৃত্বে বেলা ৩টা ১৫ মিনিটে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিতে দেখা যায়। তাঁর পাশে থাকা এক যুবক, ফরহাদুল ইসলাম চৌধুরী ওরফে রিন্টু, শটগান হাতে ধরা পড়েন। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক উপসমাজসেবা–বিষয়ক সম্পাদক। সঙ্গে থাকা আরেকজনকে অস্ত্র কোমরে গুঁজতে দেখা যায়, তবে পরিচয় জানা যায়নি। এই সমস্ত অস্ত্রধারীর কেউই গ্রেপ্তার হননি।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মাহমুদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ত্রগুলো হাতবদল হওয়ায় উদ্ধারে সময় লাগছে। গ্রেপ্তারের অভিযান চলছেই।’ প্রকাশ্যে অস্ত্রধারীদের এক বছরেও গ্রেপ্তার করতে না পারায় উদ্বেগ জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘অস্ত্রধারীরা ধরা না পড়লে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাটবে না।’
এক বছর পেরিয়ে গেলেও ২৭ অস্ত্রধারী এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। এই ধারা দেখাচ্ছে, নগরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে। একদিকে আন্দোলনকারীরা এখনও আতঙ্কে রয়েছে, অন্যদিকে পলাতক অস্ত্রধারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয়। পুলিশের অভিযান চললেও অস্ত্র উদ্ধারের জটিলতা, হাতবদল এবং পলাতকদের গা ঢাকা দেওয়ায় গ্রেপ্তারের গতি ধীর। সুজনসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন মনে করিয়ে দিচ্ছে, অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা দূর হবে না।
চট্টগ্রামে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো শুধু একক হামলার চিত্র নয়, এটি স্থানীয় রাজনীতি ও সমাজে সহিংসতার বিস্তারকেও তুলে ধরে। সঠিক তদন্ত, দ্রুত গ্রেপ্তার এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে নগরের শান্তি ফিরবে এবং জনগণ স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে পারবে।

