মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটকে ঘিরে বড় ধরনের তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে এ তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে কিছু এজেন্সির কার্যক্রমের তথ্য গুছিয়ে আনা হয়েছে।
প্রথম ধাপে আলোচনায় এসেছে ‘ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল’। এর মালিক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদউদ্দিন চৌধুরী। সিআইডির আবেদনের ভিত্তিতে তাঁর ব্যাংক হিসাব ইতিমধ্যেই জব্দ করা হয়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের পর থেকে ফাইভ এম মালয়েশিয়ায় ৯ হাজার ৩৭০ কর্মী পাঠিয়েছে।
আরেকটি আলোচিত প্রতিষ্ঠান হলো রুহুল আমিন স্বপনের ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল। বায়রার (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ) সাবেক মহাসচিব স্বপনের এজেন্সি ২০১৫ সালের পর থেকে শুধু মালয়েশিয়ায়ই ৪৫ হাজার ২৮৭ কর্মী পাঠিয়েছে। পাশাপাশি সৌদি আরবে ১ হাজার ৯৮ জন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৪৯ জন কর্মী গেছেন এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
তদন্তে উঠে এসেছে, নির্ধারিত সরকারি ফির বাইরে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হতো। এভাবে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছেন অনেক এজেন্সির মালিকরা। সিআইডি জানিয়েছে, শুধু স্বপনের প্রতিষ্ঠানই মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে প্রায় ৬৭৯ কোটি টাকা তুলেছে। অথচ সরকারি হিসাবে তাদের পাওনা হওয়ার কথা ছিল ৩৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাড়তি আদায় হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার আদালত স্বপনের ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ জব্দ করেছে। এর মধ্যে রাজধানীর বসুন্ধরা, উত্তরা ও বনানীতে প্রায় ২৩১ কাঠা জমি রয়েছে। ব্যাংক হিসাবের তথ্য জানতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকেও (বিএফআইইউ) চিঠি দিয়েছে সিআইডি। শিগগিরই তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা হবে।
তদন্তে আরও নাম এসেছে স্বপনের সহযোগী আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূরের। ১৯৯৫ সাল থেকে মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই ব্যবসায়ী স্বপনের সঙ্গে মিলে ‘বেস্টিনেট’ নামে একটি কোম্পানি চালান। মাইগ্রাম নামের সফটওয়্যারের মাধ্যমে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিবন্ধন করানো হতো, যা পরিচালনা করে এই কোম্পানিই।
সিআইডির তথ্য বলছে, মালয়েশিয়ায় যারা গেছেন তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। অনেকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে দুই থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত। সরকারি নির্ধারিত ফি ছিল মাত্র ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা।
২০১৫ সালে মাত্র ১০টি এজেন্সিকে অনুমতি দিয়েছিল মালয়েশিয়া সরকার। পরে এটি বেড়ে একশতে দাঁড়ায়। তবে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ ওঠে, এসব এজেন্সি সিন্ডিকেট তৈরি করে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে বায়রার পক্ষ থেকে সিআইডির প্রধানকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। চিঠিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ মুস্তফা কামাল, সাবেক এমপি নিজাম হাজারী, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজির আহমেদ, মাসুদউদ্দিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন মহি, রুহুল আমিন স্বপনসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়।
চিঠির ভিত্তিতে শুরু হয় তদন্ত। প্রথম ধাপে পাঁচটি এজেন্সির বিরুদ্ধে তদন্ত গুছিয়ে আনা হচ্ছে। এগুলো হলো মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল, রুহুল আমিন স্বপনের ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, নিজাম হাজারীর স্নিগ্ধা ওভারসিজ, আ হ মুস্তফা কামালের অরবিটাল এন্টারপ্রাইজ এবং বেনজির আহমেদের আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল।
তদন্তে আরও বেরিয়ে এসেছে, এসব এজেন্সির বাইরে সাব-এজেন্ট ও দালালদেরও অর্থ লেনদেনে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। সর্বনিম্ন দেড় লাখ থেকে সর্বোচ্চ ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে প্রতিজনের কাছ থেকে।
এদিকে, সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশে-বিদেশে এই সিন্ডিকেটের অবৈধ সম্পদের খোঁজ চলছে। বিএফআইইউর সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মামলার পর ইন্টারপোলের সহায়তায় বিদেশে পলাতকদের গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) আওয়ামী লীগের সাবেক চার সংসদ সদস্য—আ হ মুস্তফা কামাল, নিজাম হাজারী, মাসুদউদ্দিন চৌধুরী ও বেনজির আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে।
তথ্য অনুযায়ী, শুধু মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৩৭টি ব্যাংক হিসাবে ৭৯ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে এসব হিসাবে জমা আছে প্রায় ৬ কোটি টাকা।
সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার আল-মামুন জানিয়েছেন, শ্রমবাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত একশ এজেন্সির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। শিগগিরই মানি লন্ডারিং মামলাও করা হবে।

