রাজধানীর পুরানা পল্টনে সুসজ্জিত একটি বাড়ি, আড়ম্বরপূর্ণ অফিস, নামি ব্র্যান্ডের গাড়ি আর ভিআইপির মুখোশে সাজানো এক ব্যক্তি। প্রথম দেখায় মনে হয় তিনি প্রভাবশালী এক কূটনীতিক। অথচ এই চাকচিক্যের আড়ালে গড়ে উঠেছিল ভয়ংকর প্রতারণার সাম্রাজ্য। সাধারণ মানুষের উন্নত জীবনের স্বপ্ন ভেঙে হাজারো মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছেন তিনি। পাসপোর্ট, সঞ্চয় আর ভবিষ্যৎ সবকিছু চলে গেছে প্রতারকের হাতে।
এই চক্রের মূলহোতা মশিউর রহমান। তিনি নিজেকে বেলিজের অনারারি কনসাল জেনারেল পরিচয়ে তুলে ধরেছিলেন। অথচ সেই পরিচয়ের আড়ালে গড়ে তুলেছেন ভুয়া ভিসার আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট। নকল সিলমোহর, ইউরোপ-আমেরিকার জাল ভিসা, চার্টার্ড বিমানের ভুয়া বুকিং টিকিট, এমনকি ভিআইপিদের সঙ্গে সাজানো ছবি—সবকিছু ব্যবহার করতেন প্রতারণার ফাঁদ পেতে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রতারণার কৌশল এতটাই নিখুঁত ছিল যে শুরুতে কেউ টেরই পাননি। অনেকেই ইউরোপ-আমেরিকায় ভালো জীবনের আশায় জমিজমা বিক্রি করেছেন, পরিবারের শেষ সঞ্চয় তুলে দিয়েছেন। বিনিময়ে পেয়েছেন জাল ভিসা আর ভুয়া বিমানের টিকিট। অনেকে ঋণের চাপে বাড়িছাড়া, কেউ আবার এলাকাছাড়া হয়েছেন। সব হারিয়ে তারা এখন উদভ্রান্তের মতো ঘুরছেন মশিউরের খোঁজে।
মধ্য আমেরিকার ছোট্ট দেশ বেলিজ মূলত কৃষি, পর্যটন ও সেবাখাতনির্ভর। ২০২১ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশে এ দেশের অনারারি কনসাল জেনারেল নিযুক্ত হন মশিউর রহমান। তার দায়িত্ব ছিল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও সম্পর্ক বৃদ্ধির কাজে সহায়তা করা। কিন্তু দায়িত্বের আড়ালে তিনি তৈরি করেন আন্তর্জাতিক প্রতারণার চক্র। এই কাজে তার সহযোগী স্ত্রী, দন্ত চিকিৎসক রুমানা আফরোজ। স্বামী-স্ত্রীর ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন অগণিত মানুষ।
মশিউরের হাতে জমা আছে হাজারো মানুষের পাসপোর্ট ও ভুয়া ভিসা। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ব্যবহার করেছেন দামি গাড়ি, প্রেস সেক্রেটারি আর চাকচিক্যময় অফিস। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে ভিআইপি ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে ছড়াতেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনেক ছবিই ছিল ফটোশপ করা। এসব ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টালে প্রকাশ করাতেন ভুয়া সংবাদ।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের ২৮ জুন ‘শাপলা টিভি’ নামের একটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—“স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বেলিজের অনারারি কনস্যুলার মো. মশিউর রহমান।” তবে প্রতিবেদনে বিস্তারিত কিছু ছিল না। আবার ‘দৈনিক নতুন সময়’ নামে আরেকটি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত শিরোনাম ছিল—“প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বেলিজের অনারারি কনস্যুলার মশিউর রহমান।” কিন্তু ওই খবরের ভেতরে ক্লিক করলেও কিছুই পাওয়া যায়নি।
গুগলে খুঁজলে আরও এমন অসংখ্য ভুয়া প্রতিবেদন মেলে, যা সাজানো ছবি ও ভিআইপি পরিচয়ের আড়ালে প্রতারণার সাম্রাজ্য গড়তে সাহায্য করেছে মশিউর রহমানকে।
রাজধানীর পুরানা পল্টনের ভিআইপি কূটনীতিকের মুখোশে সাজানো মশিউর রহমান আসলে গড়ে তুলেছিলেন ভয়ংকর প্রতারণার সাম্রাজ্য। ইউরোপ-আমেরিকায় স্বপ্নের জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে তিনি ফাঁদ পাততেন সাধারণ মানুষের সামনে। ভিআইপিদের সঙ্গে তোলা ছবি ও ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করে দেখাতেন প্রভাবশালী পরিচয়। আর এভাবেই শত শত মানুষকে ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করেছেন তিনি।
প্রতারিতদের একজন নূর মিয়া। তিনি জানান, মাইনুদ্দিন নামে একজনের সঙ্গে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলার পরেই শুরু হয় তার সর্বনাশ। মাইনুদ্দিন তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ও পাসপোর্ট নেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই পাসপোর্টে ভিসার সিল দেখানো হয়, এমনকি বিএমইটির ছাড়পত্র ও বিমানের টিকিটও দেওয়া হয়। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের আরও চারজন তার কাছে ভিসার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। মোট ৬৭ লাখ টাকা দিয়ে পাঁচজনের পাসপোর্ট জমা দেওয়া হয়।
কিন্তু নির্ধারিত তারিখে ভ্রমণ সম্ভব হয়নি। টিকিট বাতিল করে নতুন তারিখ দেওয়া হয় বারবার—১৪ জানুয়ারি, ২৪ জানুয়ারি, ৬ ফেব্রুয়ারি, পরে আবার ১৪ ফেব্রুয়ারি। তবুও ফ্লাইট হয়নি। অবশেষে জানা যায়, সব ভিসাই ছিল ভুয়া। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নূর মিয়া বলেন, “আমার গ্রামে একটি দোকান ছিল, পাওনাদাররা সেটা নিয়ে গেছে। আমি সব হারিয়েছি। এখন গ্রামে ফিরতে পারি না, ঢাকায় পালিয়ে বেড়াই।”
অনুসন্ধানে আরও শতাধিক ভুক্তভোগীর সন্ধান মেলে। কুমিল্লার সোহাগ হোসেন মশিউরের কাছে ৫৬ জনের পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। তার পাওনা ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এখন তিনি নিঃস্ব হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দিদার ভূঁইয়ার পাওনা ১৭ লাখ, আরেকজন মাইনুদ্দিনের ২০ লাখ টাকা আটকে গেছে। ভুক্তভোগীদের হিসাব বলছে, অন্তত হাজারো মানুষের জীবন এ প্রতারণার ফাঁদে ধ্বংস হয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই প্রতারণা চক্রে জড়িত ছিলেন মশিউরের স্ত্রী দন্ত চিকিৎসক রুমানা আফরোজ এবং বিএমইটির বহির্গমন শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা। চক্রটির আস্তানা ছিল পুরানা পল্টনের ৫০ নম্বর রুহামা কমপ্লেক্সে। সেখানে রুমানা ডেন্টাল ক্লিনিক নামে একটি চেম্বার থেকে প্রতারণার কাজ চালাতেন তারা। এমনকি একজন কথিত সাংবাদিক সুমন চৌধুরীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন ‘প্রেস সেক্রেটারি’ হিসেবে, যাতে মানুষ সহজে আস্থা পায়।
প্রতারণার কৌশল ছিল অত্যন্ত নিখুঁত। ইউরোপের ভুয়া ভিসা বানানো হতো অবিকল আসলের মতো। আর বেলিজের ভিসা মশিউর নিজেই সিল-স্বাক্ষর দিয়ে ইস্যু করতেন। জাল ভিসার সঙ্গে থাকত নকল মাইগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স। উদাহরণস্বরূপ, ইমরান হোসেন নামে এক ভুক্তভোগীর (পাসপোর্ট নং এ০৪৫৯১৩৭৩) নামে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয়েছিল বিজেড-আই-২০২৪-৪০০০৬৩ নম্বরে। একইভাবে আমাদুল হক বিজয়, উমায়ের হোসেন, মাইন উদ্দিন রাজুসহ আরও অনেকে ভুয়া ক্লিয়ারেন্স পান।
প্রতারণার শিকার হওয়া কয়েকজনের নাম ও পাসপোর্ট তথ্যও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। কুমিল্লার কামরুল হাসান (পাসপোর্ট নং ইই০৮৩৫২১৫), ঢাকার আরিফুল ইসলাম (এ০০৯৪২৫০৯), কুমিল্লার মাসুদ রানা (এ০০৮০৯১২৮), জুবায়ের হোসেন (এ০২০৮৮৬৭৭), নিজাম হোসেন (এ০১৭৯৩৬৯৯), নোয়াখালীর নাসির উদ্দিন (এ০১৯৯৫২৫৩), হাফিজুর রহমান (এ০১৭৫৮১৬৫), আলমগীর হোসেন (এ০২১৩৫৭৮৬), জাবেদ (এ০১৮৭৬৪৮৭), ফাইজুল করিম (এ০১৯৪৭৭৬২), আরাফাত শাহজাহান (এ০১৮০৮৭৮০), নাইমুর রহমান (এ০০৬৮১১৭৮), ফয়সাল উদ্দিন (এ০০১৮২৪৬৪), আরমান হোসেন (বিডব্লিউ০১৮১৭৬৩), মারুফ উজ জামান (এ০২১৭২৬৩০), রাশেদ হোসেন (এ০০৫৪৮২৬৬), ফয়সাল আহমেদ (ইএফ০৩৩৮৪৯৯), অন্তর শাহা (ইএ০০৭৪০৩১)—সবাই এখন প্রতারিত।
এই ভয়ংকর প্রতারণার জাল শুধু মানুষের অর্থ নয়, তাদের আশা-ভরসা ও ভবিষ্যৎও কেড়ে নিয়েছে। অফিস বন্ধ করে স্ত্রীসহ পালিয়ে গেছেন মশিউর রহমান। আর ভুক্তভোগীরা আজও ছুটছেন ন্যায়বিচারের আশায়।
বেলিজের নামে যেসব ভুয়া ভিসা ইস্যু করেছেন মশিউর রহমান, তার মধ্যে অনেক ভিসার বিপরীতে বৈধ ছাড়পত্র দিয়েছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব ভিসা নিরীক্ষা করেও বিএমইটি ছাড়পত্র দিয়েছে। এমনকি কিছু কপিও কালবেলার হাতে এসেছে। অথচ বিএমইটির ছাড়পত্র মানেই নিরাপদ অভিবাসনের নিশ্চয়তা। ভিসা ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র যাচাই করেই এ অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ভিসাই যেখানে জাল, সেখানে মাইগ্রেশনই সম্ভব নয়। এ ধরনের ছাড়পত্রে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বিএমইটির বহির্গমন শাখার উপপরিচালক মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, “এটা তো হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। কীভাবে হলো আমি বুঝতে পারছি না। তাছাড়া তখন আমি এখানে ছিলামও না।”
ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতারণার ধাপ ছিল খুব পরিকল্পিত। প্রথমে ইউরোপে ভালো জীবনের স্বপ্ন দেখাতেন মশিউর। টাকা জমা দিলে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অবিকল আসলের মতো দেখতে ভুয়া ভিসা পাসপোর্টে লাগিয়ে দিতেন। এরপর জাল ভিসায় ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স করিয়ে দিতেন, বুকিং দিতেন বিমানের টিকিট। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতো এক মাসেরও কম সময়ে। গ্রামের সাধারণ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত, কোনো কিছু না বুঝেই সহায়-সম্বল বিক্রি করে টাকা তুলে দিতেন মশিউরের হাতে।
এরপর শুরু হতো সময়ক্ষেপণ। ফ্লাইটের আগের দিন টিকিট বাতিল করে নতুন তারিখ দিতেন তিনি। নিজের অফিসিয়াল প্যাডে দেওয়া এমন নির্দেশনার নথিও পাওয়া গেছে। এক নথিতে লেখা ছিল—“রিপাবলিক অব বেলিজের নির্দেশ মোতাবেক যাত্রীদের ফ্লাইট ৩ জুন ২০২৩ তারিখে নির্ধারণ করা হয়েছে। বেলিজের মাননীয় সেক্রেটারি তাদের একই ফ্লাইটে নিয়ে যাবেন, কোনো অবস্থায় তারিখ পরিবর্তন হবে না।” কিন্তু এসব তারিখ, সরকারি প্যাড আর সিলমোহর সবই ছিল প্রতারণার অংশ।
কালবেলা একাধিকবার ফোন ও বার্তা পাঠিয়ে মশিউরের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি সাড়া দেননি। ১৮ আগস্ট নয়াপল্টনের অফিসে গিয়ে দেখা যায় সেটি তালাবদ্ধ। ভবনের অন্য ভাড়াটিয়ারা জানান, দুই মাস আগে তিনি স্ত্রীসহ পালিয়ে গেছেন। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে চাননি। তবে তারা স্বীকার করেছেন, বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। সত্য প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বেলিজের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দেশটির কনস্যুলার অফিসে ই-মেইল করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, “এটা ভয়াবহ প্রতারণা। কনস্যুলার নিজেই যদি প্রতারণা করে, মানুষ কোথায় যাবে? তাকে কীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত এবং দায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এটি বহুমাত্রিক প্রতারণা। মশিউর রহমান ছাড়াও তার নিয়োগের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন—পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কারণ গোয়েন্দা সংস্থার ছাড়পত্র ছাড়া এমন নিয়োগ হয় না।”
তিনি আরও বলেন, “সঠিক তদন্ত হলে মানব পাচার ও অর্থ পাচারের মতো বিষয়ও সামনে আসতে পারে।”

