কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গারা জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে তালিকাভুক্ত করছে। তারা ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্টও করছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগ রোহিঙ্গা জেল খাটার পর আবার জালিয়াতি চক্রে যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে একজন হাফেজ আহমদ (৫০) বিশেষভাবে নজরকাড়া। তিনি কক্সবাজার শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাহাড়তলি সাত্তারের ঘোনা এলাকার বাসিন্দা। ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে জন্ম নিবন্ধন ও সর্বশেষ এনআইডি সংগ্রহ করেন। পরে কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
হাফেজসহ সাত রোহিঙ্গা দীর্ঘ ছয় মাস কারাগারে ছিলেন। কারাভোগ শেষে হাফেজ থেমে যাননি। তিনি পরিবারের অন্য সদস্যদের এনআইডি এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে তালিকাভুক্তির কাজে জড়িয়ে পড়েন। জানা গেছে, জেল খাটার পর তিনি মেয়ে জান্নাত আরার নামে এনআইডি (নম্বর-৯১৭৯০৯৯৭৪৩) সংগ্রহ করেছেন।
মেয়ের পাসপোর্ট করানোর জন্য হাফেজ কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে যাননি। তবে নোয়াখালী জেলা পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে কাগজপত্র জমা দিয়ে পাসপোর্ট ডেলিভারি স্লিপ নেন। পরে কক্সবাজার সদর মডেল থানা পুলিশ এটি জব্দ করে।
পুলিশ জানায়, হাফেজ জন্মসূত্রে রোহিঙ্গা। কক্সবাজার শহরে আসার পর থেকে এনআইডি সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। তিনি কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের বামনকাটা গ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করে আরও দুটি এনআইডি সংগ্রহ করেছিলেন। হাফেজ জানতে পেরেছেন, তার পুরনো এনআইডি বাতিল হবে। এরপর তিনি নতুন এনআইডি সংগ্রহের জন্য আবেদন করেন। সাবেক কাউন্সিলর ওসমান সরওয়ার টিপু ২০২৪ সালের ৩১ মার্চ সেই আবেদন প্রত্যয়ন করেন। কাউন্সিলর জানালেও হাফেজের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি তার কাছে ছিল।
হাফেজের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মামলা (নম্বর-জিআর-৯৭৫/১৯) হয়। পুলিশের হাতে তার ভুয়া এনআইডি (নম্বর-৫১০৮১০৯৮৬৮) জব্দ হয়। হাফেজের স্ত্রী সনজিদা বেগমও কয়েক মাস কারাগারে ছিলেন। মামলায় হাফেজসহ সাত রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে ১৯ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। মামলা এখনও বিচারাধীন।
আরেক রোহিঙ্গা সৈয়দ আলম কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাত্তারের ঘোনা মহল্লার বাসিন্দা। তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ, ভোটার আইডি ও পাসপোর্ট প্রদানের চক্রের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগে মামলা করেছে।
পুলিশ জানায়, রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দালালের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন সংগ্রহ করছে। নাম, পিতা বা স্বামীর নাম মিলিয়ে তারা কাগজপত্র তৈরি করছে।
গত ২০ জানুয়ারি সাতক্ষীরার কয়ারপাড়া থেকে জন্ম নিবন্ধন সংগ্রহ করে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দুই রোহিঙ্গা নারী পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। উখিয়ার কুতুপালং ৪ নম্বর শিবিরের বাসিন্দা রাবেয়া খাতুন রাফিয়া (১৬) ও মারজান বিবি (২২) নামের দুই আবেদনকারী যাচাইকালে দেখা যায়, জন্ম নিবন্ধনের কপি সাতক্ষীরা এলাকার। পরে তাদের কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সোপর্দ করা হয়।
কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন জানান, সন্দেহ হলে কাগজপত্র যাচাই করাই জালিয়াতি ধরা পড়ে। দালালরা ছবির পরিবর্তন করে ভুয়া তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা করে। আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন থাকায় কাজ সহজ ছিল, এখন আবেদনকারীর কাগজ ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হয়।
রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা আজিজা নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে কক্সবাজার শহরে স্থানান্তরিত হয়ে হালিমাপাড়ায় বসতি গড়ে তোলেন। তার মেয়ে রেসমিকা বেগম কক্সবাজার বালিকা মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী। কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানান, মাদরাসার অধ্যক্ষ দেখে চমকে যান, কারণ রেসমিকার কোনো জাতীয়তা সনদ বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই।
মাহবুবুর রহমান বলেন, এনআইডি ও অন্যান্য কাগজপত্র ছাড়া শত শত রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। তারা ভবিষ্যতে সরকারি চাকরিতেও প্রবেশের সুযোগ পেতে পারে। রোহিঙ্গাদের উপর তেমন কোনো তদারকি নেই। ৮ মে তিনি কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে ৯ জন রোহিঙ্গার ভুয়া এনআইডির তথ্যসহ লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এসব কাগজপত্রে প্রকৃত মা-বাবার নামও সঠিকভাবে নেই।

