দেশের নদীসমূহের অবৈধ দখলের সমস্যা ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বড়াল নদী এ সমস্যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এক বা দুইজন নয়, মোট ১০১ জন মিলিয়ে নদীটি দখল করেছে।
নদী দখলদাররা সরকারি নিয়ম-কানুন অমান্য করে জমি ও পানি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, নদী দখলের কারণে জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নদী রক্ষা করতে প্রয়োজন কার্যকর আইন ও কঠোর নজরদারি। দখলকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে নদী হারানোর ঝুঁকি বাড়বে। সরকারের উচিত তৎপর হয়ে নদী সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। বড়াল নদীর দখলের ঘটনা শুধু নদী নয়, স্থানীয় কৃষি ও পরিবেশের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদী দখল প্রতিরোধে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। প্রশাসনকে আরও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট, দেশের নদী রক্ষায় না পারলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় অগোচরে বাড়তে পারে। বড়াল নদী সেই সতর্কবার্তার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
তবে স্থানীয় ভূমি দপ্তর তাহাদের তালিকা করিলেও বাদ পড়িয়াছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম। অথচ বড়াল নদের সর্বাধিক জায়গা দখল করিয়া আছে চারঘাট পৌরসভা। যেইখানে প্রতিষ্ঠানটি বড়ালের উৎসমুখের পাশেই গণশৌচাগার ও নদীর ভিতর দিয়া চলাচলের পাকা সড়ক নির্মাণ করিয়াছে। এমনকি সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যাইতেছে, পৌর মার্কেটও নির্মিত হইয়াছে বড়ালে জমি ভরাট করিয়া। পৌরসভার স্যানিটারি ল্যান্ডফিলও গড়িয়া উঠিয়াছে নদের জায়গায়। তারপরও দখলদারের তালিকায় পৌরসভার নাম নেই কেন?

বড়াল সংকটের অশুভ সূচনা সেই ১৯৮৪ সালে, যেইখানে রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় নদের উৎসমুখে স্লুইসগেট নির্মাণ করায় উহার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত। এই প্রকারে নদটিকে পদ্মা নদী হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া বানানো হইয়াছে ‘মরা বড়াল’। এই সুযোগে বড়ালের দুই তীর দখল করিয়া গড়িয়া তোলা হইয়াছে আবাসিক ভবন, মার্কেট, গণশৌচাগারসহ বিবিধ স্থাপনা। নদটির দখলমুক্তির প্রচেষ্টাও অবশ্য থামিয়া ছিল না। ২০০৫ সাল হইতেই কয়েক দফায় দখলদারদের তালিকা করা হইয়াছিল। স্বভাবতই সেইখানে দখলদাররূপে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নাম উঠিয়া আসিয়াছে, যেই কারণে দুই দশকেও উহার অগ্রগতি দৃশ্যমান হয় নাই। উপরন্তু দিবাবসানে দখলদারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইতোপূর্বে দখলের সহিত যদ্রূপ আওয়ামী লীগ নেতারা জড়িত ছিল, তদ্রূপ ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিএনপির সহযোগী সংগঠনের নেতার নামও নূতন করিয়া দখলদারের তালিকায় আসিয়াছে। দশে মিলিয়া কাজ করিবার আপ্ত বাক্য রহিয়াছে। এই ক্ষেত্রে দেখা যাইতেছে দশে মিলিয়া অকাজে মাতিয়াছে!
বস্তুত রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দখলের কারণেই বারংবার প্রশাসনের উদ্যোগ সত্ত্বেও উহা ব্যর্থ হইয়াছে। এমনকি ২০১৯ সালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করিয়া বড়াল উচ্ছেদ কমিটিও গঠন করা হইয়াছিল। রাজনৈতিক চাপে শেষ পর্যন্ত উচ্ছেদ সম্ভব হয় নাই। তাহার পরও সম্প্রতি স্থানীয় ভূমি দপ্তর যে তালিকা করিয়াছে, উহা সাধুবাদযোগ্য। বস্তুত প্রতিষ্ঠানটির ১০১ জনের তালিকায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম না আসিবার কারণেই পরিবেশবাদী সংগঠনগুলির আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ মে বড়ালের উৎসমুখ পরিদর্শন করেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বড়ালের পানিপ্রবাহ ফিরাইয়া আনিবার লক্ষ্যে সংকুচিত স্থান খনন ও উৎসমুখের স্লুইসগেট অপসারণের যেই নির্দেশ দিয়াছেন, উহা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তদনুযায়ী স্লুইসগেটের রেগুলেটর অপসারণ করিয়াছে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো। দখলদারদের তালিকাও ইতোমধ্যে হালনাগাদ করা হইয়াছে। তদুপরি পাউবো কোনো ব্যবস্থা লয় নাই। দখলদারদের উচ্ছেদ কার্যক্রমও আরম্ভ হয় নাই।
স্মরণে রাখিতে হইবে, বড়ালের প্রাণ ফিরাইতে যত উদ্যোগই লওয়া হউক, দখলদারের প্রকৃত তালিকা ও প্রকৃষ্ট উচ্ছেদ অভিযান ব্যতীত সকলই গরল ভেল! স্বীকার্য, নদী সুরক্ষায় আমাদের আইন ও আদালতের নির্দেশনা রহিয়াছে। নদী সুরক্ষা যদি সত্যই সরকারের অগ্রাধিকারে থাকে, আমরা উহার প্রতিফলন কার্যক্ষেত্রে দেখিতে চাহিব। নাগরিকের বাঁচিবার জন্যই দেশের নদনদীকে রক্ষা করিতে হইবে। সেই সদিচ্ছার প্রমাণ আমরা বহুল আলোচিত বড়াল সুরক্ষার মধ্য দিয়াই দেখিতে চাহিব। সূত্র: সমকাল

