বাংলাদেশি কর্মীরা বিদেশ যাওয়ার আগে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময়ে এখনও শোষণের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশ ও মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সরকারি নির্ধারিত মেডিকেল সেন্টারগুলো অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। ভুয়া রিপোর্টের অভিযোগও এসেছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সরকারি ফি প্রায় ১০ হাজার টাকা হলেও অনেক কর্মী দ্বিগুণ বা তারও বেশি টাকা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সময় অযোগ্য শ্রমিককে যোগ্য হিসেবে সার্টিফিকেট নিতে ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। প্রবাসী শ্রমিক ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, এ কারণে বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা)-এর সাবেক যুগ্ম মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, ‘মাত্র ২–৫ শতাংশ কর্মী নির্ধারিত ফিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারেন। বাকিদের অন্তত ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়।’ তিনি ব্যাখ্যা করেন, বেশিরভাগ মেডিকেল সেন্টারই বিভিন্ন ‘সমস্যা’ দেখিয়ে কর্মীদের কাছ থেকে টাকা নেয়। একবার অযোগ্য হলে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হারানোর ভয়ে শ্রমিকরা আগেভাগে দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে নেন।
চট্টগ্রামের ফাহিম মাহমুদ জানান, তিনি একটি সেন্টারে ৮,৫০০ টাকা দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিলেন। অযোগ্য হওয়ার পর ঢাকার পান্থপথে আরও ৫০,০০০ টাকা দিয়ে ফিট সার্টিফিকেট নিয়েছেন। কুয়েতে পৌঁছালে পুনরায় পরীক্ষা করতে হয়েছে মাত্র ৫ দিরহাম। তার অভিবাসন ব্যয় ছিল প্রায় ১০ লাখ টাকা। তার এক বন্ধুকে চট্টগ্রামের সেন্টারে একই কাজের জন্য ৮৫,০০০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। সমস্যার মূল কারণ গালফ হেলথ কাউন্সিলের (জিএইচসি) অনুমোদিত মেডিকেল সেন্টারের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া।
বিদেশগামী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে প্রথমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, তারপর জিএইচসির অনুমোদন নিতে হয়। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব গালফ মেডিকেল সেন্টারস (বিএজিএমসি) জানিয়েছে, ২০১৭ সালে জিএইচসি অনুমোদিত সেন্টার মাত্র ২৬টি ছিল। বর্তমানে তা বেড়ে ২৬০টি। প্রতিবেশী দেশের তুলনায় সংখ্যা অনেক বেশি। ভারতের ১৬৭, পাকিস্তানের ১২৪, নেপালের ৩০ ও শ্রীলঙ্কার ২৭টি সেন্টার রয়েছে। বিএজিএমসির প্রেসিডেন্ট নোমান চৌধুরী বলেন, ‘অনেক সেন্টার শুধু পাসপোর্টের ফটোকপির মাধ্যমে রিপোর্ট দেয়। বছরে ৫০,০০০ থেকে এক লাখ টেস্ট করা অসম্ভব। সেন্টারের দৈনিক ক্ষমতা সর্বোচ্চ ৭০-৮০ জন।’ খাত সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, অনুমোদন কার্যক্রমে দুর্নীতি আছে। সিন্ডিকেট ঘুষ দিয়ে সেন্টার অনুমোদন পাইয়ে দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মঈনুল আহসান বলেন, ‘যদি ল্যাবের যন্ত্রপাতি মানসম্মত হয়, অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে বিদেশে কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে গালফ হেলথ কাউন্সিলের বিষয়। জালিয়াতি বা অনিয়মের অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ কর্মীরা ভুয়া বা অসম্পূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেলে সেখানকার পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এটি বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) জানায়, ২০২১–২০২৫ সালের মে পর্যন্ত চারটি প্রধান উপসাগরীয় দেশ – সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতে ৩২,৪১,২১০ জন বাংলাদেশি কর্মসংস্থান পেয়েছেন। টিপু সুলতান বলেন, প্রায় ৯৫ শতাংশকে কমপক্ষে ১০,০০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। অবৈধভাবে হাতিয়ে নেওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩,৭৯০ কোটি টাকা। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও ওমানগামী কর্মীদের জিএইচসি’র প্ল্যাটফর্মে ১০ ডলার ফি দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। অভিযোগ, প্রথমে প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, পরে যোগ্য করার জন্য ঘুষ দাবি করা হয়। প্রকৃত অযোগ্যরাও মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে যোগ্য সার্টিফিকেট পাচ্ছে।
মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের কাছ থেকেও গত তিন বছরে প্রায় ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সি অতিরিক্ত ৩৫৫ কোটি টাকা হাতিয়েছে। নির্ধারিত ফি ৬,৫০০ টাকা হলেও এজেন্সিগুলো প্রত্যেকের কাছ থেকে ১১,০০০ টাকা নিয়েছে। বায়রার সদস্য আলতাব হোসেন বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা বলে মেডিকেল করানোর নাম করে সাধারণ মানুষ লুটপাটের শিকার হয়েছে। অনেকেই বিদেশে যেতে পারেনি।’
২৬০টি গালফ অনুমোদিত সেন্টারের মধ্যে ১৮৬টি ঢাকায়। অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতার কারণে মালিকেরা লড়াই করে টিকে থাকতে বাধ্য। কিছু অসাধু গোষ্ঠী জিএইচসি’র সিস্টেম হ্যাক করে আবেদনকারীদের নিজেদের সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছে। বিএজিএমসি জানিয়েছে, অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ না করলে শ্রমবাজার ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে। নোমান চৌধুরী বলেন, একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট এবং কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা এ বিশৃঙ্খলা চালাচ্ছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জিএইচসিকে চিঠি দিয়েছে অনিয়ম করা মেডিকেল সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। যুগ্মসচিব এজেডএম নুরুল হক বলেন, ‘আমরা উভয়পক্ষকেই চিঠি দিয়েছি। আশা করি দ্রুত তদন্ত হবে।’
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘ভুয়া কাগজপত্রের সঙ্গে অনেক পক্ষ জড়িত। এজেন্ট ও সংগঠিত গ্রুপ সবাই এর অংশ। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, তবে একক প্রচেষ্টায় সমাধান সম্ভব নয়। সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন।’ টিপু সুলতান জানান, গত দুই সপ্তাহে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের চাপের কারণে কয়েকজন অতিরিক্ত টাকা না দিয়েও মেডিকেল সার্টিফিকেট পেয়েছেন।

