বাংলাদেশের নন ব্যাংকিং আর্থিক খাত দীর্ঘ সময় চাপের মধ্যে রয়েছে। পাঁচ বছর আগে পিকে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারির পর অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের পর তিনি দেশ ছাড়েন।
অমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক অবসায়নের সিদ্ধান্তেও গিয়েছিল। তবে আদালতের নির্দেশে পরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় কার্যকর করা হয়। তবে পুনরুজীবনের পরও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। আমানতকারীদের অভিযোগ, তারা এখনও নিজের জমানো অর্থ পুরোপুরি ফেরত পাননি।
প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী অর্থ ফেরত দেওয়া হচ্ছে। যাদের আমানতের সীমা পাঁচ লাখ টাকা, তারা পুরো অর্থ পাচ্ছেন। তবে এ সীমার বাইরে আমানতকারীদের শুধু ১০ শতাংশ হারে অর্থ ফেরত দেওয়া হচ্ছে। ফলে বড় অঙ্কের আমানতের ক্ষেত্রে পুরো অর্থ ফেরত পাওয়া এখনো অনিশ্চিত এবং সময়সাপেক্ষ বিষয়। এই পরিস্থিতি তুলে ধরছে নন ব্যাংকিং আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ঘাটতি। আমানতকারীদের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে এখনও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রয়োজন।
পিকে হালদারের কেলেঙ্কারি:
বাংলাদেশের নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতে সবচেয়ে আলোচিত কেলেঙ্কারি নিয়ে নামটি উঠে আসে—প্রশান্ত কুমার হালদার, বা পিকে হালদার। দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ দখলদার ও খেলাপিদের একজন তিনি।
২০০৯ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন হালদার। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হন। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে শেয়ার কিনে তিনি দেশের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে বসান। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস
- পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস
- বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)
- এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড
পরবর্তীতে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ রয়েছে। কয়েক হাজার গ্রাহক এখনও তাদের আমানত ফেরত পাননি। এসময় বাংলাদেশের আর্থিক খাতের তদারকি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। ২০২০ সালের শুরুতে হালদারের দেশ ত্যাগের তথ্য প্রকাশ পায়। হাইকোর্ট পরে তাকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়। একইসাথে তার মা লীলাবতী হালদারসহ ২৫ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ বছরের নভেম্বরে দুদক তাকে ও মোট ১৪ জনকে চার্জশিট অনুমোদন করে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকার লেনদেন।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে তাকে গ্রেফতারের জন্য সরকার ইন্টারপোলের কাছে রেড নোটিশ পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের মে মাসে হালদার ভারতে গ্রেফতার হন। ভারতের একটি আদালত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাকে ২২ বছরের কারাদণ্ড দেয়। বর্তমানে তিনি ভারতের কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। হালদারের বিরুদ্ধে মোট ৫২টি অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের মামলা রয়েছে। যদিও সরকারিভাবে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন প্রকৃত পাচারের পরিমাণ আরও বেশি। এই ঘটনা নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ঘাটতি স্পষ্ট করছে। বৃহৎ অঙ্কের আমানতকারীদের সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত নিশ্চিত না হওয়া এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
পিপলস লিজিংয়ে অনিশ্চয়তার ছায়া:
নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতে পিকে হালদারের কেলেঙ্কারির শিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। ২০১৯ সালে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো এটি অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিষ্ঠানের ২২ বছরের কার্যক্রমের মধ্যে এটি একটি বিরল উদ্যোগ ছিল। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে গ্রাহকদের দায়দেনা শোধের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্কিম গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং পরিচালনায় একজন অবসায়ক নিয়োগ করা হয়।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের মেয়াদি আমানত ও অন্যান্য ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। তদারকির দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। ২০১৪ সালে কিছু পরিচালক অবৈধভাবে ঋণ নেওয়ার অভিযোগে অপসারিত হন। ২০১৫ সাল থেকে পিকে হালদারের পরিচিত ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে মালিকানা নেন। আগের সঙ্কটসহ এই সময় থেকে প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনতে থাকে। অবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু কয়েকজন আমানতকারীর আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠানটি পুনরুজীবিত করার আদেশ দেয়। নতুন বোর্ড গঠন করা হয় এবং ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। বোর্ডের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজে প্রতিষ্ঠানটি তাদের হাতে হস্তান্তর করা। পরে বোর্ড কয়েকবার পুনর্গঠন হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি এই নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।
পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা:
নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পিকে হালদারের কেলেঙ্কারির পর, যারা আমানত রেখেছিলেন তারা দীর্ঘ সময় ধরে অর্থ ফেরতের অপেক্ষায়। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানগুলো ডুবতে বসার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে হাজারো আমানতকারী টাকা ফেরত চেয়ে আন্দোলনে নামে। পরে তারা আদালতের দ্বারস্থ হন। পিপলস লিজিংয়ে প্রায় ছয় হাজারের বেশি আমানতকারী রয়েছেন। ব্যক্তি পর্যায়ের আমানতের পরিমাণ সাড়ে সাতশ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের নভেম্বরে সামিয়া বিনতে মাহবুব ও তার স্বামী পিপলস লিজিংয়ে প্রায় এক কোটি টাকার বেশি অর্থ ছয় মাসের জন্য আমানত রাখেন। সামিয়া বলেন, “একটা জমি কিনব বলে ছয় মাসের জন্য দুজনের সব সঞ্চয় ডিপোজিট করেছি। সেই ছয় মাস এখন ছয় বছর হয়ে গেছে। শুধুমাত্র চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণে একবার পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছি। কোনো ইন্টারেস্ট দেওয়া হয়নি। কবে নাগাদ পুরো অর্থ পাওয়া যাবে সেটাও অনিশ্চিত।” ২০২১ সালে যখন আদালত বোর্ড পুনর্গঠন করে, আমানতকারীদের একজন প্রতিনিধি বোর্ডে থাকেন। সঙ্গীতশিল্পী নাশিদ কামাল ছিলেন সেই প্রতিনিধি। তিনি বলেন, “আমার নিজের ৫০ লাখ টাকা ডিপোজিট ছিল। মাত্র পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছি। এমন অনেকে আছেন যাদের সর্বস্ব তারা আমানত রেখেছিলেন, কিন্তু এখনও ফেরত না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছেন।”
জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গীত শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসীর পরিবারের প্রায় চার কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে আমানত রাখা হয়েছিল। এখনও সেই অর্থ ফেরত পাননি। মিজ কামাল বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন। তিনি বেশ কয়েকবার স্ট্রোক করেছেন এবং অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এই তথ্যগুলো দেখাচ্ছে, পিকে হালদারের কেলেঙ্কারি শুধু অর্থ আত্মসাৎ নয়, বরং নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির কারণে হাজারো সাধারণ মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা আজও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
পিপলস লিজিংয়ে আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া:
পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সগির হোসেন খান। তিনি বলেন, “সিনিয়র সিটিজেন, চিকিৎসা, মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য চারটি ক্যাটাগরিতে আমরা আমানতকারীদের কিস্তি দিচ্ছি। ২০২১ সালে হাইকোর্টের নির্দেশের পর প্রথম কিস্তিতে টাকা দেওয়া হয়েছিল। এখন দ্বিতীয় কিস্তির টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৬৪০ জন আমানতকারীকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আমানতকারীদের ইন্টারেস্ট না দেয়ার বিষয়ে মি. খান বলেন, “২০১৯ সাল পর্যন্ত আমানতকারীদের ইন্টারেস্ট দেওয়া হয়েছে। যাদের পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে আমানত রয়েছে, তাদের পুরো অর্থ ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।” তবে পুরো অর্থ ফেরত কবে দেওয়া হবে তা এখনও অনিশ্চিত। মি. খান বলেন, “আমানতকারীদের পুরো অর্থ পরিশোধে দীর্ঘ সময় লাগবে।” এই তথ্যগুলো দেখাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ধাপে ধাপে অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া চলছে। তবে বড় অঙ্কের আমানতকারীদের জন্য পুরো অর্থ ফেরত পাওয়া এখনও চ্যালেঞ্জ এবং দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
নন-ব্যাংকিং খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান অবস্থা:
পিকে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারির পর ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) আদালত গঠিত পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড পরিচালিত হচ্ছে বিএসইসি গঠিত বোর্ডের মাধ্যমে।
পাঁচ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরবস্থা কাটছেই না। গত বছরের সেপ্টেম্বর ভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৯৬ কোটি টাকা। তবুও প্রায় পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন শুরু করেছে। ২০০৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। এখন হোম লোন, অটো লোন ও এসএমই লোনও দেওয়া শুরু হয়েছে। যারা ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি, তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালত ও চেক ডিজাইন করে প্রায় দুইশ’টি মামলা করা হয়েছে। আগে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ৭০০ কোটি টাকা চেয়ে আবেদন করেছিল।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সগির হোসেন খান বলেন, “বড় বড় ডিপোজিটরদের এমাউন্ট ইকুইটিতে রূপান্তর করতে চাই। অর্থাৎ কেউ যদি পাঁচ কোটি টাকা ডিপোজিট রাখে, সে পুরো টাকার শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানটির মালিক হলে অর্থ ফেরত দিতে হবে না।” বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিআইএফসির খেলাপি ঋণ ৯৬.৮৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৭৪৩ কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৯১২ কোটি টাকা বা ৯৪.৭৬ শতাংশ। এ প্রতিষ্ঠান থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এর মধ্যে ২০ কোটি টাকার বেশি আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৯.৫৬ শতাংশ বা ১,৬৪৫ কোটি টাকা। এই প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীরাও এখনও পুরো অর্থ ফেরত পাননি।
নন-ব্যাংকিং খাতে নতুন আইন:
পিকে হালদারের কেলেঙ্কারি ও অন্যান্য আর্থিক অনিয়মের পর নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীল করতে সরকার আইনেও পরিবর্তন এনেছে। গত বছরের নভেম্বরে সংশোধিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ফাইন্যান্স কোম্পানি আইনে নতুন বিধান যুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিবর্তিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো একক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি আমানত নিতে পারবে না কোনো ব্যাংক বর্হিভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানি। একই সঙ্গে যৌথ নামে কোনো ব্যক্তি এরকম প্রতিষ্ঠানে ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখতে পারবেন না।
আইনে আরও বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো ব্যক্তি, তার পরিবারের সদস্য বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মিলে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার কিনতে পারবে না। এছাড়া কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ারের মালিক হতে পারবে না। এই পরিবর্তনগুলো নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর ফলে ভবিষ্যতে একই রকম কেলেঙ্কারি পুনরাবৃত্তি হওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং সাধারণ আমানতকারীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান:
নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে পিকে হালদারের কেলেঙ্কারি ও অন্যান্য আর্থিক অনিয়মের পর বিশেষজ্ঞরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের অভাবকেই দায়ী করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, “কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এখন আদালতের নিয়োগ করা বোর্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। তারা ঋণগুলোর পুনরুদ্ধারেও আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “ফিন্যান্সিয়াল ডিফিকাল্টির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক যত ধরনের সহায়তা দিতে পারে, তা করছে। প্রয়োজনীয় গাইডেন্সও দেওয়া হচ্ছে। এখন আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি যে, এসব প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গভাবে তদারকি করা হবে। এরপর থেকে এ ধরনের ঘটনা আর কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লক্ষ্য করা হয়নি।”
আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের বিষয়ে মি. হক বলেন, “যেসব প্রতিষ্ঠান আদালতের নিয়োগ দেয়া বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, তারা একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থ ফেরত দিচ্ছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিছু ইতোমধ্যেই প্রতিপালিত হচ্ছে, কিছু অভিযোগ বিবেচনা করা হচ্ছে।” তিনি আশা প্রকাশ করেন, “এই খাতের সমস্যা নিরসনে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে গভর্নেন্স ও ম্যানেজমেন্ট দুটোই ধীরে ধীরে উন্নতি করবে।”
নন-ব্যাংকিং খাতের পুনরুদ্ধার ও সতর্কতা:
নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ এসোসিয়েশন এই খাতের সমস্যার সমাধান ও ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কাজ করছে। সংগঠনটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, “এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। এটি যাতে আরও না বাড়ে, সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে খেলাপি ঋণ না হয়, তাই ক্রেডিট রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে।”
আইনের পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান এই আইনে রয়েছে। আমরা সেটি দ্রুত কার্যকর করার জন্য কাজ করছি।” তিনি আরও জানান, “একইসাথে এই সেক্টর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে আমরা খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চাই।”
পিকে হালদারের কেলেঙ্কারি শুধু অর্থপাচার নয়, এটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতা ও তদারকির ঘাটতি উন্মোচন করেছে। পাঁচ বছরের পরেও অনেক আমানতকারী পুরো অর্থ ফেরত পাননি। প্রতিষ্ঠানগুলো আদালতের নিয়োগকৃত বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে ধাপে ধাপে পুনরুজীবিত হলেও খেলাপি ঋণ, বড় অঙ্কের আমানত ফেরত এবং দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি এখনও রয়ে গেছে।
আইনের সংশোধন ও কঠোর বিধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি, লিজিং কোম্পানিগুলোর সতর্কতা—সব মিলিয়ে খাতের গভর্নেন্স ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে। তবে, সাধারণ আমানতকারী ও ছোট বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো চ্যালেঞ্জ। পুনরাবৃত্তি রোধ, খাতের স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীল পরিচালনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এই সেক্টরকে স্থিতিশীল ও বিশ্বাসযোগ্য করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।