নৌপরিবহনমন্ত্রী থাকাকালীন শাজাহান খান ছিলেন প্রভাবশালী ও অপ্রতিরোধ্য। তিনি বিআইডব্লিউটিএর ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন। মন্ত্রিত্ব হারানোর পরেও তার সিন্ডিকেট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর পরও তার অনুসারীরা নতুন আঙ্গিকে বিআইডব্লিউটিএতে দাপট দেখাচ্ছেন। সূত্রের খবর, তারা চাকরিতে বহাল থেকে সংঘবদ্ধ হয়ে আওয়ামী শ্রমিক লীগের নামে বিভিন্ন স্তরে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন। এতে কিছু অসাধু কর্মকর্তা যুক্ত হয়েছেন। যদিও তাদের বিরুদ্ধে দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শাজাহান খানের রাজনৈতিক যাত্রা ১৯৬৪ সালে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তিনি মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হন। পরে জাসদে যোগ দিয়ে জেলা জাসদের যুগ্ম আহ্বায়ক হন। ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার এমপি হন। ১৯৯১ সালে জাসদ ছাড়েন এবং আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন। এরপর প্রতিটি সংসদে তিনি এমপি ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি নৌমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিআইডব্লিউটিএর প্রতিটি সেক্টরে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি বন্দরসহ বিভিন্ন সেক্টরে টেন্ডার বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। তার প্রভাবের ভয়ে সবাই ভীত থাকতেন। শাজাহান খানের বাহিনীর কারণে গত সাড়ে ১৫ বছর সাধারণ ঠিকাদাররা বিআইডব্লিউটিএতে ঢুকতে পারেননি। তার সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ কাজ পেতেন না। দুই প্রভাবশালী মন্ত্রীর লোকজন প্রমোশন, ঠিকাদারি, নিয়োগ, ঘাট ইজারাদারসহ সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা দমন ও নিপীড়ন চালাতেন।
নৌপরিবহনমন্ত্রী থাকাকালীন শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর ও স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরে বড় ধরনের কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাহাজ মেরামত ও নদী খননের ব্যবসা পরিচালনা করতেন শাজাহানের বিশ্বস্ত আবদুর রশিদ। তিনি কর্ণফুলী নদীতে ড্রাই ডক নির্মাণের সুযোগ পান। শাজাহান খান রশিদকে মাসিক মোটা টাকা দিতেন এবং ব্যক্তিগতভাবে কুমিল্লায় তার বাড়িতে দাওয়াতও দিতেন।
বিআইডব্লিউটিএর কয়েকজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কোন প্রকল্পে কে কাজ পাবে তা শাজাহান খানের মাধ্যমে ঠিক হতো। প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ৩ থেকে ৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো। ২০১০ সালে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে ওয়াটার বাস প্রকল্প শুরু হয়। প্রকল্পের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু প্রকল্পটি ২০২০ সাল থেকে বন্ধ। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা শাজাহান খানের দাপটে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এক ওয়াটার বাস তৈরিতে ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ হলেও ৪০-৫০ কোটি টাকা দেখানো হতো। ওয়াটার বাস প্রকল্প এবং বুড়িগঙ্গা খননকাজে কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
২০০২ সালে বিএনপির নৌপরিবহনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন ঢাকার যানজট নিরসনে চারটি নৌপথ সচল করেন। সে সময় দুটি ওয়াটার বাস ব্যবহার করা হয়। ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পর প্রকল্পটি বন্ধ হয়। ২০১০ সালে শাজাহান খান আবারও ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করেন। ১২টি ওয়াটার বাস তৈরি হয় এবং বাদামতলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার নদীপথে চলাচল শুরু হয়। কিন্তু প্রকল্প শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।
বিআইডব্লিউটিসির বাদামতলী ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, চারটি ওয়াটার বাস ময়লা-আবর্জনা ও জং ধরা অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী পাওয়া যায়নি। ল্যান্ডিং পয়েন্ট টার্মিনালগুলোও খারাপ অবস্থায়। কেরানীগঞ্জের গোলামোড়া টার্মিনালে নৌকার মাঝি ইদ্রিস জানান, গত পাঁচ বছরে কোনো কর্মকর্তাকে তিনি টার্মিনালে দেখেননি। টার্মিনালগুলো দখল করে আছে মাদকাসক্ত ও ছিন্নমূল মানুষ।

