দেশের বাইরে পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণের সোপান হিসেবে আইইএলটিএস পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের কাছে একটি বড় মঞ্চ। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষা নিয়েও এবার উঠেছে প্রশ্ন। রাজধানীতে পরিচালিত একটি গোপন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে একটি সংঘবদ্ধ প্রশ্নফাঁস চক্র, যারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের কাছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বিক্রি করে আসছিল।
শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) পরীক্ষার কিছু ঘণ্টা পর রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় চক্রের মূল হোতা ৩৭ বছর বয়সী মো. মামুন খান ও তার সহযোগী পন্না পুনম হালদার ওরফে কেয়াকে। পুলিশের অভিযানে নগদ ৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকা এবং আটটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
ডেইলি সানের মাসব্যাপী অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই চক্রের কার্যপদ্ধতি। কয়েকজন জনপ্রিয় কোচিং সেন্টার ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যোগাড় করা হতো এবং কমিশন দেওয়া হতো এজেন্টদের। প্রথমে কেবল রেজিস্ট্রেশন ফি নেওয়া হলেও পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট তারিখে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হতো।
হোটেলে মোবাইল, ঘড়ি ও সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস জমা দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের রাতভর কড়া নজরদারিতে রাখা হতো। রাত ১টার পর সরবরাহ করা হতো পরীক্ষার রাইটিং, রিডিং ও লিসনিং অংশের আসল প্রশ্ন ও উত্তর। শিক্ষার্থীরা এগুলো মুখস্থ করার পর পরদিন সকালে মাইক্রোবাস ও মিনিবাসে করে পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হতো।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি জনের জন্য নেওয়া হতো ১ লাখ ২৫ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক কর্মকর্তা শৈলেন চাকমা জানিয়েছেন, তিনি ২ লাখ টাকা দিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেন এবং উত্তরগুলো আসল প্রশ্নের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।
এক শিক্ষার্থী নাদিত হাসান রকি জানান, তিনি ফেব্রুয়ারি থেকে মামুনের কাছে কোচিং নিতেন। পরীক্ষার আগের রাতে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায় প্রশ্ন কেনেন এবং উত্তরগুলো ১০০% সঠিক ছিল।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে উত্তরা এলাকার হোটেল অ্যাফোর্ড ইনে রাতভর রাখা হয় প্রায় ১০০ শিক্ষার্থীকে। তাদের হাতে সরবরাহ করা হয় আসল প্রশ্নপত্র। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানো হয়। মে মাসে মতিঝিলের হোটেল সেন্ট্রাল ইনে একই কায়দায় প্রস্তুত করা হয় ১২০-১৩০ শিক্ষার্থীকে।
পরীক্ষার দিন সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে প্রশ্নপত্র হাতে পান ডেইলি সানের প্রতিবেদক, অথচ পরীক্ষা শুরু হয় দুপুর ১টায়। শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত করেন তাদের দেওয়া উত্তর ওই ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।
চক্রের অন্যতম এজেন্ট তারেক আজিজ সাংবাদিকদের জানান, ২০১৯ সাল থেকে এই ব্যবসা চলছে। কেমব্রিজ ইংলিশ, আইডিপি বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে এবং প্রশ্ন ফাঁসের জন্য তিনি ২.৫ কোটি টাকা খরচ করেছেন।
শনিবার সকালেও মামুন শিক্ষার্থীদের নাড্ডার হোটেল ওয়েস্ট ভ্যালি এবং বনানীর অ্যামাজন লিলি লেক ভিউতে রাতভর রেখে পরীক্ষার প্রস্তুতি করান। পরে পরীক্ষার পর অভিভাবকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সময় স্থানীয়রা তাকে আটক করে পুলিশে দেয়। মামুন ও কেয়াকে রোববার আদালতে পাঠানো হয়েছে।
বানানী থানার ওসি মো. রাসেল সরোয়ার বলেন, “আমরা তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালাচ্ছিল।”
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রশ্নফাঁস প্রমাণিত হলে বাংলাদেশে আইইএলটিএস সেন্টার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল ও আইডিপি দায় এড়াতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “দেশীয় পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস দুর্ভাগ্যজনকভাবে রুটিনে পরিণত হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক পরীক্ষায় এ ধরনের ঘটনা ভেতরের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া সম্ভব নয়।”
এদিকে, ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। আইডিপি বাংলাদেশের আইইএলটিএস অপারেশনের প্রধান এলোরা শাহাব শারমিন জানিয়েছেন, প্রোটোকল অনুযায়ী এই বিষয়ে মন্তব্য করার অনুমতি তার নেই।
ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। অনেকেই দেশের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সূত্র: ডেইলি সান