বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমস একটি নতুন ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছে। শিরোনাম— “Bangladesh’s Missing Billions, Stolen in Plain Sight”। সেখানে দাবি করা হয়েছে, হাসিনার আমলে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার।
পাচারের কৌশল: ব্যাংক দখল থেকে হুন্ডি
ডকুমেন্টারিতে বলা হয়, হাসিনার ঘনিষ্ঠ মহলের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে ভুয়া ঋণের নামে হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়। সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের ছত্রছায়ায় পরিচালকদের অস্ত্রের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাও উঠে এসেছে। এ অর্থ পরে হুন্ডি, অতিরিক্ত বা কম ইনভয়েস এবং বিদেশি সম্পত্তি কেনার মাধ্যমে পাচার হয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক লুটপাট। ফিনান্সিয়াল টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে একাই ৩০০টিরও বেশি সম্পত্তির মালিক। ইতোমধ্যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩৫০টি সম্পত্তি জব্দ করেছে।
বিদেশে সম্পদ ও বিতর্ক
ডকুমেন্টারিতে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের অফশোর অ্যাকাউন্ট ও বিদেশি সম্পদের কথাও উঠে এসেছে। হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও তার মেয়ে, ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় অভিযোগ রয়েছে, বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। একপর্যায়ে টিউলিপ সিদ্দিক তদন্তের মুখে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
আন্দোলন থেকে পতন
ডকুমেন্টারিতে আরও দেখানো হয়েছে, ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই কীভাবে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ গড়ে ওঠে এবং পরিণত হয় সরকারবিরোধী বিদ্রোহে। আন্দোলনকারীদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে পুলিশের গুলি, স্নাইপার শট ও হেলিকপ্টার থেকে শেল নিক্ষেপের ভয়াবহতা।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ওই দমনপীড়নে কমপক্ষে ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানালে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জ
হাসিনার পতনের পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। তিনি সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা আহসান মনসুরকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেন এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার টাস্কফোর্স গঠন করেন।
তবে কাজটি সহজ নয়। অন্তত ১১টি ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। সরকার ইতোমধ্যে ২৯০ বিলিয়ন টাকা ঢেলে দিয়েছে ব্যাংক খাত টিকিয়ে রাখতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অর্থ উদ্ধার করতে “বছরের পর বছর” লেগে যেতে পারে।
দুর্নীতির সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎ
ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়, কীভাবে দায়মুক্তি, জবাবদিহির অভাব ও দুর্বল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুঁজি পাচারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
এখন ড. ইউনূসের সরকারের ওপর দ্রুত নির্বাচনের চাপ বাড়ছে। তিনি বলছেন, আগে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান সংস্কার জরুরি। সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন হতে পারে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না এলে দেশ আবারও একচেটিয়া ক্ষমতার ফাঁদে পড়ে যেতে পারে।