এক সময় রাজধানীর আবাসনখাতে পরিচিত নাম ছিল ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেড। আধুনিক আবাসন নির্মাণের প্রতিশ্রুতিতে তারা প্রায় দুই দশক ধরে ঢাকার অভিজাত এলাকায় প্রকল্প চালু করেছিল কিন্তু বর্তমানে কোম্পানিটি ডুবে আছে মামলা, দুর্নীতি অনুসন্ধান এবং হাজারো ফ্ল্যাট ক্রেতা ও জমির মালিককে প্রতারণার অভিযোগের জালে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) জানিয়েছে, গত দেড় দশকে ডম-ইনোর ১৪২টি প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে অন্তত ৫৬টি প্রকল্পে নির্মাণের আগে সব অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করা হলেও ক্রেতাদের কাছে একটিও হস্তান্তর করা হয়নি। প্রায় দুই হাজার অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ক্রেতারা অর্থ প্রদান করেছেন। এদের বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে এখন সব প্রকল্পে শুধু অংশিক কাজ হয়েছে, বেশিরভাগই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
ফ্ল্যাট ক্রেতারা প্রতারিত:
যেসব জমির মালিক ডম-ইনোর সঙ্গে যৌথভাবে আবাসন প্রকল্প বা ভবন নির্মাণের চুক্তি করেছিলেন, তারা এখন ভাড়া বাসায় বসছেন। কারণ প্রতিশ্রুত ফ্ল্যাট তো দূরের কথা, চুক্তি অনুযায়ী প্রাথমিক অর্থও তারা পাননি। ক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা অপেক্ষা করলেও প্রকল্পের কাজ এগোয়নি। কোম্পানি মুখে বলে চলেছে ‘সমাধানের লক্ষ্য কাজ চলছে’, কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলছেন—ফ্ল্যাট হস্তান্তর এবং অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। ডম-ইনোর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুস সালাম বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন। তবে এ তথ্য স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা যায়নি। এমন দীর্ঘমেয়াদি বিলম্ব ও প্রতারণা ক্রেতা ও জমির মালিকদের জীবনে গম্ভীর আর্থিক ও মানসিক প্রভাব ফেলেছে। এটি আবাসন খাতের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
জমছে মামলার স্তূপ:
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ করেছে, ডম-ইনোর এমডি আব্দুস সালাম ক্রেতাদের প্রতারণা করে অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। এছাড়া তিনি বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়েছেন অন্যান্য খাতে, যার মধ্যে রয়েছে লিওন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। সালাম একবার দুর্নীতির মামলায় জেলও খেটেছেন। বর্তমানে ডম-ইনো ও এমডির বিরুদ্ধে ১৫০টির বেশি প্রতারণা-সংক্রান্ত মামলা চলছে। এর মধ্যে শুধু বনানী থানায় দায়ের হয়েছে ১৩৬টি মামলা। প্রতারণা, চেক জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার—সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০টি মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন।
ডম-ইনোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সালাম বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কয়েক দফা কারাগারে ছিলেন, তবে জামিনে বের হন। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবেশ পরিবর্তনের পর তিনি বিদেশে চলে গেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতগুলো মামলা ও আন্তর্জাতিক অর্থপাচার অভিযোগ দেশের আবাসন খাতের বিশ্বাসযোগ্যতাকে তলানিতে নিয়ে গেছে। এটি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা ও বাজারে স্থিতিশীলতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
ডম-ইনোর প্রতারণার কৌশল:
রিহ্যাবের সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট কামাল মাহমুদ জানিয়েছেন, “আব্দুস সালাম তার ভাই, আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সবুরের প্রভাব খাটিয়ে বছরের পর বছর এ ধরনের প্রতারণা চালিয়েছেন। কোনো সমস্যা হয়নি।” তাঁর দাবি, “শুধু অ্যাপার্টমেন্ট মালিকদের টাকা আত্মসাৎ করেননি, জমির মালিকদের সাথেও প্রতারণা করেছেন। ২০১০ সালের আগে থেকেই অনেক প্রকল্পের অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির আগে ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রেখে ঋণ নিয়েছেন। ফলে মালিকরা উঠে বসলেও নিজেদের নামে দলিল এখনো পাননি। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন সেই মর্টগেজড সম্পত্তিগুলো নিলামে তোলার জন্য মামলা করছে। ফলে মালিকানা হারাতে পারেন ক্রেতারা।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিমের ঘটনা এই পরিস্থিতির উদাহরণ। ২০০৮ সালে তিনি রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের ‘ডম-ইনো ইনভিয়ার্নো’ প্রকল্পে ১,২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী ২০১০ সালে ফ্ল্যাটটি হস্তান্তর হওয়ার কথা ছিল। তিনি বলেন, “হস্তান্তরের আগে অতিরিক্ত নির্মাণ খরচের কথা বলে ডম-ইনো প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিকের কাছ থেকে আরও দুই লাখ টাকা নেয়। ফ্ল্যাটে ওঠার পর দেখেছি নির্মাণে ত্রুটি—ছাদ দিয়ে পানি পড়ে, ব্যালকনি ত্রুটিপূর্ণ, বৃষ্টিতে গ্যারেজে পানি জমে। চুক্তি অনুযায়ী সব টাকা পরিশোধের পরও মালিকানা নিবন্ধন পেতে প্রায় ছয় বছর লেগেছে। আরও দেড় লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে চুক্তির বাইরে।” ব্যারিস্টার হালিম আরও বলেন, “ফ্ল্যাট কেনা থেকে মালিকানা পাওয়া পর্যন্ত ছিল শুধু ভোগান্তি। আমি আইনজীবী হয়েও ছয় বছর লড়াই করেছি। সাধারণ ক্রেতাদের দুর্ভোগ তা বহুগুণ ভয়াবহ।”
ডম-ইনোর অন্যান্য প্রকল্প থেকেও শত শত মানুষ একই দুর্ভোগে পড়েছেন। অনেকে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনলেও ফ্ল্যাট না পাওয়ায় ঋণ শোধ করতে না পেরে আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছেন। যেমন, ২০০৮ সালে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার একটি প্রকল্প থেকে ১,৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছিলেন ব্যবসায়ী মাহমুদুল হাসান। দাম ৯২ লাখ টাকা, যার মধ্যে ৭০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ। ১৬ বছরেও প্রকল্প শেষ হয়নি। তিনি বলছেন, “আমি এখন ফ্ল্যাটবিহীন, ঋণের কারণে মামলার ঝামেলায় আছি।” ব্যারিস্টার হালিম জানিয়েছেন, প্রতারিত ক্রেতারা টাকা ফেরত পাবেন কি না তা নির্ভর করছে চলমান মামলার নিষ্পত্তির ওপর। চাইলে ক্রেতারা ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে পারেন। আদালত প্রতিকার দিতে সক্ষম।
চুক্তি লঙ্ঘনের উদাহরণ অজস্র:
রাজধানীর আরমানিটেলায় বাসিন্দা আকবর আলী । পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া তার ২৬ কাঠা জমির ওপর ১০৪টি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণে ২০০৭ সালে ডম-ইনোর সঙ্গে চুক্তি করেন। শর্ত ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে ভবন নির্মাণ শেষ করে অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করা কিন্তু চুক্তির ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও কাজ অসম্পূর্ণ। ২০১৫ সালে আকবর আলী ডম-ইনোর বিরুদ্ধে মামলা করেন। কোম্পানির এমডি আব্দুস সালাম হলফনামা দিয়ে আদালতকে আশ্বস্ত করেন কাজ পুনরায় শুরু হবে কিন্তু আকবর অভিযোগ করেন, কাজ শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি। মাত্র ৩০ শতাংশ কাজ হয়েছে, এবং ভবন এখন পরিত্যক্ত অবস্থায়।
চুক্তি অনুযায়ী ১০৪ ফ্ল্যাটের অর্ধেক অর্থাৎ ৫২টি ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা ছিল আকবরের । তিনি বলেন, “এখনও শুধু গ্রাউন্ড ফ্লোরের কাজ হয়েছে। ডম-ইনো চুক্তির পরই আমার ভাগের ৫২টি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, দেরিতে হস্তান্তর করলে প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকা ভাড়া দিতে হতো, কিন্তু সেটিও দেওয়া হচ্ছে না। প্রায় ১০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এখন পথে বসার অবস্থা।”
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী আমিনুল হকও একই প্রকল্পে ১২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কেনার জন্য প্রায় ১৮ বছর আগে ৮০ লাখ টাকা দিয়েছেন। ফ্ল্যাট না পাওয়া ছাড়াও টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না। আমিনুল বলেন, “প্রবাস জীবনের উপার্জনের বড় অংশ দিয়েছি। না পেলে বুঝতাম না তাদের প্রতারণা। মামলা করেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।” বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি শুধু এই প্রকল্পেই নয়। প্রায় ৫৬টি ডম-ইনো প্রকল্পে একইভাবে জমির মালিক ও ক্রেতারা ভুক্তভোগী হয়েছেন। অগ্রিম টাকা নেওয়া হলেও ফ্ল্যাট হস্তান্তর হয়নি বা বছরের পর বছর বিলম্বিত হচ্ছে।
ডম-ইনোর ৫৬ প্রকল্পে চলমান অভিযোগ:
রিহ্যাবের কাছে ফ্ল্যাট ক্রেতা ও জমির মালিকরা অভিযোগ করেছেন, গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডি সহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেডের ৫৬টি আবাসন প্রকল্প জড়িত। বেশিরভাগ প্রকল্প ১৫-১৮ বছর আগে শুরু হলেও এখনো সম্পন্ন হয়নি। ক্রেতারা জানিয়েছেন, প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেও ফ্ল্যাট পাননি। কিছু জমির মালিকও অভিযোগ করেছেন, চুক্তি অনুযায়ী অর্থ এখনও পরিশোধ করা হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে নয়াপল্টনের ৫৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের প্রকল্প। ২৯ কাঠা জমির ওপর পাঁচটি বিলাসবহুল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে, জমি নিলেও প্রকল্পটি ২০০৭ সালে অনুমোদিত হয়েছিল। ২০১৪ সালে চুক্তি অনুযায়ী হস্তান্তর সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও ভবনটির মাত্র ৪০ শতাংশ কাজ শেষ। নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। জমির মালিকরা অভিযোগ করেছেন, গত ১৪ বছর ধরে তারা ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। চুক্তি অনুযায়ী দেরিতে হস্তান্তরের জন্য মাসিক ৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ভাড়া দেওয়া হতো, যা এখনও দেওয়া হয়নি। এ প্রকল্পে অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতা ৭০ জনের বেশি প্রতারিত হয়েছেন। কাজ শেষ না করেই প্রতিটি ক্রেতার কাছ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা করে নেওয়া হয়েছে।
জমি মালিকের স্বাক্ষর জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ:
বনানীর আবাসিক এলাকায় মো. সিরাজুল ইসলাম ১৯৭৪ সালে তৎকালীন ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) থেকে পাঁচ কাঠা জমি পান। মৃত্যুর পর ওই প্লটের ওয়ারিশ সূত্রে তার স্ত্রী বেগম রোকেয়া ইসলাম, ছেলে মো. এনামুল হক ও মো. একরামুল হক, মেয়ে আক্তার বানু ও নাহিদ আক্তার মালিক হন।
২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেডের সঙ্গে ফ্ল্যাট নির্মাণের চুক্তি হয়। অভিযোগ, এনামুল হক স্বাক্ষর না দিয়েও ডম-ইনো একটি আমমোক্তারনামা ব্যবহার করে নির্মাণ শুরু করে। এনামুল হক ২০০৫–২০১০ সাল পর্যন্ত লন্ডনে ছিলেন। দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, ডম-ইনোর এমডি আব্দুস সালাম রাজউকের অনুমোদনের জন্য এনামুল হকের স্বাক্ষর জাল করেন।
এই অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলী আকবর ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর বনানী থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে জাল সিল-স্বাক্ষর ব্যবহার করে মিথ্যা নকশা অনুমোদন দেখিয়ে নির্মাণকাজ করার অভিযোগ রয়েছে। মামলাটি এখনও ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন। আব্দুস সালাম একবার কারাগারে গেছেন, পরে জামিনে মুক্তি পান।
স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ ছাড়াও সালামের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের তদন্তে বলা হয়েছে, ২০১৫–১৬ অর্থবছরে তিনি আয়কর রিটার্নে মোট ২৯.১০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য দেন। তবে সম্পদের উৎস প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। উল্লেখিত আয়ের উৎস ঘোষিত সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে তদন্তে উঠে আসে। ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেড এবং এমডি আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, চেক প্রত্যাখ্যান ও অর্থপাচারের অভিযোগে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫০টি মামলা দায়ের হয়েছে। বেশিরভাগ মামলা দায়ের করেছেন রিয়েল এস্টেট খাতের গ্রাহকরা ও দুদক। ডম-ইনোর আবাসন প্রকল্প থেকে সংগৃহীত অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের অভিযোগে দুদক আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে। তদন্তে সম্পৃক্ত দুদকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ডম-ইনোর আবাসন প্রকল্পের জন্য নেওয়া অর্থ ব্যবহার করে আব্দুস সালাম অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি অ্যাফিক্সবিডি নামে একটি কৃষি ও উৎপাদনভিত্তিক কোম্পানির মালিক। এছাড়া ২০১৩ সালে তিনি লিওন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় বাজারে ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করছে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। দুদকের কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, ফ্ল্যাট ক্রেতাদের বিনিয়োগ করা অর্থ ব্যবহার করেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। অথচ ডম-ইনো বিনিয়োগকারীদের প্রতিশ্রুত অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবুও আব্দুস সালামের এসব কোম্পানির কার্যক্রম এখনও চলছে।
২০০২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ডম-ইনো প্রপার্টিজ লিমিটেড দ্রুত বিকশিত হয়। একের পর এক প্রতিষ্ঠান প্রায় ২৫৪টি আবাসিক প্রকল্প নির্মাণ সম্পন্ন করে। শীর্ষ সময়ে কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার এক হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছিল কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে ডম-ইনোর কার্যক্রমে ধস নামে। খাত সংশ্লিষ্টরা এবং কোম্পানির সাবেক কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালামের অনিয়ম ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড এই অবনতির মূল কারণ।
ডম-ইনোর এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, “বিভিন্ন প্রকল্পে আব্দুস সালাম জমির মালিকদের কাছ থেকে জমি নিয়েছিলেন। নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই ফ্ল্যাট বিক্রি করে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। পরে সেই অর্থ দিয়ে আলাদা কয়েকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিও রয়েছে। এমনকি বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশেও পাঠানো হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “যেসব প্রকল্প শেষ হয়েছে, সেখানে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রেতাদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয়েছে। রাজউকের নকশা অনুমোদনের জন্য জাল স্বাক্ষরও ব্যবহার করা হয়েছে। আব্দুস সালাম আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে এসব করেছেন।”
এসব অভিযোগের বিষয়ে ডম-ইনোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন বন্ধ ছিল। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তার কোনো সাড়া মেলেনি। কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ওমর ফারুক গত ৩১ আগস্ট জানান, “কোম্পানি ঝামেলার মধ্যে আছে। এমডি (আব্দুস সালাম) দেশের বাইরে আছেন। কোন দেশে রয়েছেন জানি না। আমরা চেষ্টা করছি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতা ও জমির মালিকদের সমস্যা সমাধান করার। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ভালো সমাধান আসছে।”
ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতাদের জন্য সমাধান সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম বলেন, “প্রতারিত ক্রেতারা চলমান প্রতারণার মামলার ওপর নির্ভর করে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। চাইলে এককভাবে বা একাধিক ক্রেতা মিলে হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে পারেন।” তিনি আরও বলেন, “যেসব জমির মালিক জমি দিয়েছেন ডম-ইনোকে, সেগুলো সাধারণত স্থায়ী পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। ফলে সহজে বাতিল করা সম্ভব নয়। নিম্ন আদালতেও সুনির্দিষ্ট প্রতিকার পাওয়া যাবে না কিন্তু যারা অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ের চুক্তি করেছেন, তারা রিট করতে পারেন। আদালত তাদের ন্যায্য অংশ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন এবং সরকারি কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিতে পারেন।”
ব্যারিস্টার হালিম আরও উল্লেখ করেন, “যদি আদালতের নির্দেশে পরিত্যক্ত প্রকল্পগুলো তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, আদালত তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে পারবে। এমনকি রিটের মাধ্যমে বিশেষভাবে ডম-ইনোর সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একটি কমিশন গঠন করার প্রস্তাবও করা যেতে পারে।