দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের সময় সাধারণত সংশ্লিষ্ট গ্রুপ, কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং স্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) ও জব্দ (ক্রোক) করা হয়। তবে ওরিয়ন গ্রুপের ক্ষেত্রে এটি করা হয়নি।
দুদকের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত ৩১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলেও গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর শতাধিক অ্যাকাউন্ট সচল রাখা হয়েছে। একইভাবে, মালিকদের নামে থাকা ৪৩ একর জমি ক্রোক করা হলেও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কোনো স্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সম্পদ ফ্রিজ বা ক্রোক করার জন্য আদালতে কোনো আবেদনও করা হয়নি।
গতকাল দুদকের উপপরিচালক আকতারুল ইসলাম বলেন, “অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অর্থসম্পদ ফ্রিজ বা জব্দ করার সিদ্ধান্ত অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নেন। তার আবেদন অনুযায়ী আদালত অবরুদ্ধ ও জব্দের নির্দেশ দেন।”
দুদকের একটি সূত্র জানিয়েছে, ওরিয়ন গ্রুপের সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ ও স্থাবর সম্পদ ক্রোক করার বিষয়ে দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে আলোচনা করেছেন। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে কর্মচারীদের আয়-রোজগারে সমস্যা সৃষ্টি হবে। তাই মালিকদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ও জমি ক্রোক করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আদালতও সেই অনুযায়ী নির্দেশ দিয়েছেন।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, ১০ মার্চ ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিম, তার স্ত্রী আরজুদা করিম, ছেলে সালমান ওবায়দুল করিম ও মেয়ে জেরিন করিমের ৩১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের নির্দেশ দেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত। ওই দিন পর্যন্ত অ্যাকাউন্টগুলোতে মোট ২০ কোটি ২৬ লাখ ৮০ হাজার ৬৫৮ টাকা এবং ৬ হাজার ৫৭৫ মার্কিন ডলার ছিল।
সর্বশেষ আদালতের আদেশে, জেরিন করিমের নামে রাজধানীর গুলশানে প্রায় ৪ হাজার স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট এবং ময়মনসিংহ ও মুন্সীগঞ্জে ওবায়দুল করিম, আরজুদা করিম ও সালমান ওবায়দুল করিমের নামে থাকা ৪৩ একর ৬ শতাংশ জমি ক্রোক করা হয়েছে। বেশিরভাগ জমি ফসলের মাঠ। পরিবারের মালিকানাধীন গাড়ি, বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্য সম্পদ ফ্রিজ বা ক্রোক করা হয়নি।
এদিকে, দুর্নীতির অভিযোগে বিচারাধীন অবস্থায় ওবায়দুল করিম দেশ ছাড়েছেন। তিনি ডোমিনিকান পাসপোর্ট ব্যবহার করে ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। এর আগে তার বিদেশ যাত্রায় দুটি দফা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। ৩০ জুলাই আদালতের অনুমতি নিয়ে কৌশলে দুদককে ফাঁকি দিয়ে তিনি দেশ ছাড়তে সক্ষম হন।
ওবায়দুল করিমের দীর্ঘ দুর্নীতির ইতিহাস রয়েছে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১৪টি দুর্নীতি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ৪৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১১টি মামলা হয়েছে। এক মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সমপরিমাণ জরিমানা, অন্য মামলাগুলোতে ৪৮ বছরের কারাদণ্ডসহ নানা সাজা কার্যকর করা হয়েছে। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ে কিছু মামলা স্থগিত থাকলেও এখনও অনিষ্পন্ন।
ওবায়দুল করিম ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রুগ্ন কোম্পানি কোহিনুর কেমিক্যাল লিমিটেডের লিজ নিয়ে ব্যবসায় আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৩ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এরপর বিভিন্ন জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ব্যবসায় নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সরকার পতনের পরও ওরিয়ন গ্রুপের দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুদক মাঠে নেমেছে। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে।