জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) সম্প্রতি দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশে গোপন সম্পদের নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে। তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অন্তত ৫২ জন বাংলাদেশি বিদেশে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন। এই ব্যক্তিদের পাসপোর্ট ইতোমধ্যে জব্দ করা হয়েছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। তবে আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে সিআইসি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)ও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে অনুসন্ধান
গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সিআইসির বিশেষ টিম সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, লন্ডন, নিউইয়র্ক, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা ও কুয়ালালামপুরে উল্লেখযোগ্য সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই এবং লন্ডনে। এখন পর্যন্ত ব্যক্তি ও কোম্পানির নামে মোট ৩৪৬টি সম্পত্তি শনাক্ত হয়েছে।
এছাড়া, এই প্রভাবশালীরা বিদেশি নাগরিকত্ব ক্রয় করে বিদেশি পাসপোর্টও সংগ্রহ করেছেন। অন্তত ৩৫২ জন বাংলাদেশি এই সুযোগ নিয়েছেন—যার মধ্যে দেশগুলো হলো অ্যান্টিগুয়া ও বারবুডা, অস্ট্রিয়া, ডোমিনিকা, গ্রেনাডা, সেন্ট কিটস ও নেভিস, নর্থ মেসিডোনিয়া, মাল্টা, সেন্ট লুসিয়া ও তুরস্ক। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, একজন প্রার্থী প্রায় ১২ লাখ ডলার খরচ করে পাসপোর্ট পেয়েছেন।
কর ফাঁকি ও আইনি প্রক্রিয়া
এনবিআরের সূত্র জানায়, শনাক্ত হওয়া কর ফাঁকিদাতাদের কাছ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবিব বলেন, “দেশের বাইরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন এই ৫২ প্রভাবশালী ব্যক্তি। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, এরা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছেন।”
তদন্তে উঠে এসেছে, পাচারের সঙ্গে শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরাও জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো, সিকদার গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, ওরিয়ন, সামিটসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ এবং বিদেশি ব্যবসায়ী আদনান ইমামের আইপিই গ্রুপও এ তালিকায় রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও টাস্কফোর্স
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে ১১টি সংস্থার সমন্বয়ে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তারা বেক্সিমকো, এস আলমসহ একাধিক গ্রুপের সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক চারটি সংস্থা—স্টার, আইএসিসিসি, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এবং আইসিএআর—পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার ও প্রক্রিয়ায় কাজ করছে।
সিআইসির অবস্থা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
মহাপরিচালক আহসান হাবিব জানান, “এখন পর্যন্ত ধরা পড়া সম্পদের পরিমাণ মোট পাচারের তুলনায় সামান্য। আরও অনেক সম্পদের সন্ধান রয়েছে, যা উদঘাটনে সময় লাগবে। পুরো অনুসন্ধান শেষ হলে তালিকা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হবে।”
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে সিআইসি, দুদক ও সিআইডি সমন্বিতভাবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে দেশের সম্পদ লুটের ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য, “দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া একটি ভয়াবহ দেশদ্রোহিতা। ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য সুন্দর দেশ গড়তে হলে এসবের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য।”

