চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলের মামলায় সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের বেশি নতুন মুখ। পুলিশ জানিয়েছে, অর্থাৎ ধরা পড়া ব্যক্তিদের অর্ধেকের বেশি আগে কখনও এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল না।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশের আট বিভাগে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগে ৬৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৭১ জন নতুন অপরাধী। অর্থাৎ মোট গ্রেপ্তারের ৫৭.০৮ শতাংশ নতুন চাঁদাবাজ বা দখলদার। এ সময়ে দুই অপরাধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে ঢাকা বিভাগে। ঢাকা মহানগর ও বিভাগের ১৩টি জেলা থেকে ৩২৩ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২২৩ জন নতুন চাঁদাবাজ বা দখলদার। পুলিশের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নতুন অপরাধীদের সংখ্যার বৃদ্ধি মূলত কয়েকটি কারণে ঘটছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হলো আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সৃষ্ট শূন্যতা ও অস্থিরতা, যা অসাধু নতুন লোকের সুযোগ নেওয়ার প্রবণতা বাড়িয়েছে। এছাড়া মোট ছয়টি কারণ পুলিশ চিহ্নিত করেছে, যা চাঁদাবাজি ও দখলবাজি বৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের পরিচয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। পুলিশ বলেছে, নতুন মুখরা এ অপরাধে প্রবেশ করছে সামাজিক ও রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় নাজুক ছিল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উন্নতি পেলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে নতুন অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়েছে। তারা চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলের মতো তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত।
এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান নিকেতনের ২ নম্বর গেটের পাশে। রাজউকের ২৭ কাঠা জমি দখল নিতে যায় একটি চক্র। খবর পেয়ে রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘটনাস্থলে যান। তখন দখলদাররা তাদের হুমকি দেয়। রাজউকের লোকজন গুলশান থানায় ফোন করলে পুলিশ গিয়ে চারজনকে আটক করে। এদের মধ্যে রয়েছেন রুহুল আমিন রাহুল, মোস্তাক আহম্মেদ, ইকবাল হোসেন বুলেট ও নৃপেন ব্যাপারী। এছাড়া মো. আব্দুল রহমান সোহেল ও জসিম উদ্দিন নামের দুই ব্যক্তি পালিয়ে যান। পরে রাজউকের উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম গুলশান থানায় মামলা করেন। আটক চারজনকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পুলিশ জানিয়েছে, নিকেতনের ঘটনায় গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে তিনজনই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তারা পালিয়ে যাওয়া আব্দুল রহমান সোহেলের হয়ে সরকারি জায়গা দখল করতে এসেছিলেন। ইকবাল হোসেন বুলেট বরগুনা জেলা যুবদলের সহসভাপতি এবং রুহুল আমিন রাহুল বরগুনার তালতলী উপজেলা যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অতীতে কোনো দখলবাজির রেকর্ড নেই। তাই তারা পুলিশের কাছে নতুন অবৈধ দখলদার হিসেবে পরিচিত।
রাজধানীর গুলশান ও লালবাগে সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদাবাজি ও সরকারি জায়গা দখলের ঘটনা নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। মামলার বাদী, রাজউকের উপসহকারী প্রকৌশলী জানান, গুলশান নিকেতনের ওই জায়গা হাতিরঝিল প্রকল্পের অংশ, যেখানে লেডিস পার্ক করার পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের পরিবর্তনের পর থেকে আব্দুল রহমান সোহেল এই জায়গা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা অনেক গাছ কেটে টিনের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খবর পেয়ে সেখানে গেলে সোহেল ও তাঁর লোকজন হুমকি-ধমকি দেন।
গুলশানের এ ঘটনার মতো বহু চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলের অভিযোগে নতুন অপরাধীরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর লালবাগে। মাস কয়েক আগে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসায়ী মো. শফিক শহীদনগর বেড়িবাঁধ এলাকায় অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ মো. চান মিয়া ও তাঁর কয়েকজন সহযোগী শফিককে ঘিরে ধরেন এবং হুমকি দেন। চান মিয়া জানান, এলাকায় থাকতে হলে মাসে ১ লাখ টাকা দিতে হবে। টাকা না দিলে শফিক ও তাঁর ভাইকে এলাকা ছাড়তে হবে বা মারধরের ভয় থাকবে।
পুলিশ গত ৮ জুলাই চান মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। ৯ জুলাই ব্যবসায়ী শফিক লালবাগ থানায় মামলা করেন। তিনি জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চান মিয়া এলাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিলেন। পরে খোঁজ-খবর থেকে জানা গেছে, চান মিয়া ২৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সভাপতি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি লালবাগ বেড়িবাঁধের ঘোড়াপট্টিতে সরকারি জায়গা দখল করে রিকশার গ্যারেজ স্থাপন করেন। এ ছাড়া ওই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে চাঁদাবাজি চালিয়ে আসছিলেন। পুলিশের বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজনৈতিক শূন্যতা ও সামাজিক অস্থিরতা নতুন চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলদারদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। নতুন অপরাধীরা স্থানীয় রাজনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে এই ধরনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে।
নতুন চাঁদাবাজি ও দখলদারদের উত্থানের ছয়টি কারণ:
চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলের ঘটনায় নতুন মুখের প্রবেশ এবং তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর ছয়টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে। পুলিশ বলছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো আওয়ামী লীগের পতনের পর পুরোনো অপরাধ সিন্ডিকেটের দুর্বল হয়ে ‘শূন্য স্থান’ তৈরি হওয়া। এছাড়া রাজনৈতিক দলের সুযোগসন্ধানী নেতা-কর্মীরা অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে। আগের মতো নজরদারির বাইরে থাকা অপরাধীরা এখন সক্রিয় হতে গিয়ে ধরা পড়ছে।
চাঁদাবাজি ও দখলের প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো পরিবহন, বাজার, আবাসন ও শ্রমিক সংগঠন। স্থানীয় রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি স্থানীয় দাপট ও ক্ষমতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। গ্যাং সংস্কৃতি ও অন্যান্য কারণে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও নতুন চাঁদাবাজরা উঠে আসছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ড. মো. আশরাফুর রহমান বলেন, “সমাজের অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে কিছু ব্যক্তি। তারা রাতারাতি অনেক কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আমরা তাদের গ্রেপ্তার করছি, আইনের আওতায় আনছি। ধারাবাহিকভাবে এই কাজ আমরা চালিয়ে যাচ্ছি।”
পুলিশের বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক শূন্যতা নতুন চাঁদাবাজি ও দখলদারদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। নতুন অপরাধীরা স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।