বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ডিজিটাল নম্বরপ্লেট পেতে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শেষ নেই। এই সুযোগে একদল কর্মকর্তা নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছেন। মিরপুর, উত্তরা, ইকুরিয়া ও পূর্বাচল শাখা থেকে শুরু করে সারা দেশে চলছে এই অবৈধ অর্থ বাণিজ্য। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে জানা গেছে, এভাবে প্রতি মাসে প্রায় ২৫ লাখ টাকা লুটপাট হচ্ছে।
নিয়মিত ফি বনাম অবৈধ আদায়: বিআরটিএর নিয়ম অনুযায়ী,
- কমার্শিয়াল নম্বরপ্লেট স্থানান্তরে ফি ৩ হাজার ৬৫২ টাকা,
- মিডিয়াম প্লেটের ক্ষেত্রে ৩ হাজার টাকা,
- মোটরসাইকেলের প্লেটে ২ হাজার ২৬০ টাকা,
- নিবন্ধন সনদ হস্তান্তরে ৫৫৫ টাকা।
কিন্তু বাস্তবে কর্মকর্তারা আদায় করছেন:
- কমার্শিয়াল প্লেটে ৫ হাজার টাকা,
- মিডিয়াম প্লেটে ৪ হাজার টাকা,
- মোটরসাইকেলে ৩ হাজার টাকা,
- নিবন্ধন সনদ হস্তান্তরে ২ হাজার টাকা।
দুদকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এ দুর্নীতির মূল নেতৃত্বে আছেন ঢাকা মেট্রো সার্কেল-১ এর ব্যবস্থাপক আল আমিন। ২০১২ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি নম্বরপ্লেট সেকশনকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। একাধিকবার শাস্তির সুপারিশ করা হলেও ঘুষ দিয়ে পার পেয়ে গেছেন। অভিযোগ আছে, তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাসে প্রায় ২৫ লাখ টাকা ঘুষ দেন। আল আমিনের সম্পদের তালিকাও চমকপ্রদ। রাজধানীর মিরপুরে ৮০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট, বগুড়ায় কোটি টাকার মশারির ব্যবসা, ৬ লাখ টাকার গাড়ি ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল সম্পদ রয়েছে তার।
সিন্ডিকেটের সদস্যরা আল আমিন সিন্ডিকেটে জড়িত:
- মাকসুদুর রহমান
- প্লাবন রোজারিও
- ডমিনিক ফালিয়া
- ইশতিয়াক আহমেদ
এ ছাড়া নম্বরপ্লেট তৈরির কারিগরি সহায়তাদাতা প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির একদল কর্মকর্তা এই দুর্নীতিতে যুক্ত। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রকল্প পরিচালক আহসান হাবীব, কারিগরি প্রধান রুহুল রনি, সহায়ক বেলাল হোসেন, হিসাবরক্ষক আক্কাস আলী, সমন্বয়ক মাসুদ সুজনের সহযোগী রক্সি এবং এইচ আল হুমায়রা। এমনকি সাবেক প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন ও বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শীতাংশু শেখর বিশ্বাসের নামও এসেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সিন্ডিকেটের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী হয়েছে।
প্রতিটি সার্কেল থেকে অতিরিক্ত আদায়ের টাকা আলাদা হিসাব করা হয়। কার কত ভাগ তা নির্ধারণ করে শেষে বড় অঙ্কের অর্থ আল আমিনের কাছে পাঠানো হয়। টাইগার আইটির হিসাবরক্ষক আক্কাস আলী এই অর্থ বিলি-বণ্টনের দায়িত্বে থাকেন। আক্কাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজের নিরাপত্তার জন্য তিনি কর্মকর্তাদের বদলি করাতেও ঘুষ দিয়েছেন। শীতাংশু শেখরকে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে তিনি এক ব্যবস্থাপককে বদলি করিয়েছেন বলেও জানা গেছে।
২০১২ সালে ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রকল্পে যুক্ত হয়ে টাইগার আইটির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালে বিআরটিএ তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলেও এখনো রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন নম্বরপ্লেট প্রকল্পে প্রতিষ্ঠানটি সক্রিয়। একই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্তও করে।
দুদকের অনুসন্ধান চললেও অভিযুক্তদের কাছ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি। বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ মো. সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “দুদক থেকে এখনো কোনো চিঠি পাইনি। তবে নানা দুর্নীতির তথ্য পাচ্ছি। সব অভিযোগ যাচাই করা হবে। প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

