জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের কাছে প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর কার্যালয় ৯১৫ জন শীর্ষ অর্থপাচারকারীর নাম এবং তাদের পাচারের পরিমাণ ও বিদেশে গঠিত সম্পদের বিস্তারিত তালিকা হস্তান্তর করেছে। তালিকায় কোথায়—কতটা অর্থ পাঠানো হয়েছে এবং সেই অর্থ দিয়ে কোন দেশে কী সম্পদ গড়া হয়েছে—সবই সংযুক্ত আছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব তথ্যকে কাজে লাগিয়ে পাচারের অর্থ ফেরতের জন্য সহায়তা চেয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
কার্যালয় সূত্র জানায়, দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিকে নিয়ে ১১ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। টাস্কফোর্সের সদস্যরা এনবিআর, সিআইডি, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, কাস্টমস হাউসসহ আমদানি-রফতানি সম্পর্কিত অন্যান্য অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কাজ করেছেন। এসব যাচাই শেষে দুই হাজারের বেশি ব্যক্তির নামের তালিকা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ৯১৫ জনকে শীর্ষ অর্থপাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তালিকায় প্রত্যেকের পাচারের পরিমাণ ও বিদেশে থাকা সম্পদের হিসাব আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাস্কফোর্সের এক সদস্য সংবাদদাতাকে বলেন, “টাস্কফোর্স থেকে পাচারকারীদের নাম, পাচারের পরিমাণ ও সম্পদের পরিমাণ সব তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই তালিকা ধরে এগোলে পাচারের অর্থ আদায় করা সম্ভব হবে। ওই ৯১৫ জনের নিয়েই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে কারণ এদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি।”
টাস্কফোর্স জানায়, পাচারের অর্থ আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত করা হয়েছে। অনেকের ওই অর্থ দিয়ে বিদেশে সম্পদ কেনা হয়েছে এবং ব্যবসা স্থাপন করা হয়েছে। এসব টাকা ফিরে পেতে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। বিশেষত যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ওই দেশগুলোতে যাবেন, তখন তাদের সর্বাত্মক আইনি সহায়তা নিশ্চিত করার অনুরোধ করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “বাংলাদেশ থেকে শীর্ষ অর্থপাচারকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের পাচার করা অর্থ ও সেই অর্থ দিয়ে কেনা সম্পদ বিক্রি করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা চালানো হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কিছু অসৎ ব্যক্তি বিভিন্ন কৌশলে অর্থ পাচার করেছেন। ফেরত আনা টাকাগুলো সাধারণ জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা হবে। জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া হয়েছে এবং যেসব দেশে টাকা গেছে সেসব দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও যোগাযোগ চলছে।”
প্রতিবেদন অনুযায়ী তালিকায় জায়গা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে প্রাক্তন ও চলমান রাজনীতিক, সরকার অফিসার, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এবং বড় ব্যবসায়ী। তালিকায় উল্লেখিত কয়েকটি নামের মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, টিউলিপ সিদ্দিকী, সজীব ওয়াজেদ জয়সহ শেখ পরিবারের প্রায় ১০০ সদস্য। তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন সময়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা। আনুমানিক ৫০ জন সংসদ সদস্যের নাম আছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র ৯ এবং কাউন্সিলর ১১ জনের নাম তালিকাভুক্ত। সরকারি অফিসার ১৫ এবং পরিচিত কয়েক শত ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে।
তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রীরা আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের, শাজাহান খান, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, টিপু মুনশি, দীপু মনি; সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু; প্রতিমন্ত্রী আরিফ খান জয়; জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং তার স্ত্রী কনিকা; আসাদুজ্জামান খান কামালের স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান। ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড (নগদ লিমিটেড) ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের নাম রয়েছে।
সামরিক ও পুলিশি পেশার কিছু উচ্চপদস্থ ব্যক্তিও তালিকায় রয়েছেন। তালিকাভুক্ত নর্থ-সাউথ সেক্টরের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। এছাড়া সাবেক অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশীদ বিশ্বাস, যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্যদের নামও তালিকায় আছে।
সরকারের জমা দেওয়া তালিকার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত শ্বেতপত্রের হিসাবও এতে সংযুক্ত রয়েছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর পাচার ও দুর্নীতির তথ্য নিয়ে একটি বিশদ শ্বেতপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে যে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা এবং বিচার বিভাগের কিছু মানুষ পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শ্বেতপত্র অনুযায়ী গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকা প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, “২৩৪ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। এই টাকা ফেরানো ড. ইউনূসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে তিনি আলাপ করেছেন। বিশ্বব্যাংক আমাদের সাহায্য করবে বলে আশা করছি।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বিগত সময়ে দুর্নীতির পথেই অর্থ পাচার হয়েছে। এসব অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। বিদেশে লফার্ম নিয়োগ ও সেই দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্যে আইনি পথে টাকা ফেরত আনা যায়। যেসব দেশে পাচারের অর্থে সম্পদ তৈরি হয়েছে, সেগুলো বিক্রি করে অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা উচিত। সময় লাগবে তবে সম্ভব।”
টাস্কফোর্স ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সূত্র উদ্ধৃত করে রাখা এই প্রতিবেদনটি বলছে—প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন। এখন প্রয়োজন যৌথ আইনগত প্রয়োগ, আন্তর্জাতিক সমন্বয় এবং দ্রুত কৌশলগত উদ্যোগ। পাচারের অর্থ ফিরে না আনলে জনগণের ক্ষতিটা কাটবে না বলেই প্রতিবেদনের দাবি।

