মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার জামালপুর গ্রামে মেঘনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলে ২২ আগস্ট চালু হয় একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। এর দুই দিন পর, ২৫ আগস্ট ক্যাম্পটিতে হামলা চালায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। তারা পুলিশের দিকে শতাধিক গুলি ও ককটেল নিক্ষেপ করে। পরে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে দুটি অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের একটি পুলিশের বলে শনাক্ত হয়েছে, যা থানা লুটের সময় সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গিয়েছিল।
র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান জানান, উদ্ধার হওয়া অস্ত্রটির সিরিয়াল নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছিল, যাতে শনাক্ত না হয়। শুধু মুন্সিগঞ্জ নয়, লুট হওয়া অস্ত্র ব্যবহার করে সারা দেশে পুলিশের ওপর হামলা, খুন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশের ওপর হামলা, থানায় লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া, শত শত সাজাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক থাকা এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার চার শতাধিক আসামির কারামুক্তি জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় দেশের বিভিন্ন কারাগার ও থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। পুলিশ সদর দপ্তর ও কারা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, তখন লুট হওয়া ১ হাজার ৩৭৬টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২ লাখ ৬৫ হাজার ১৩৪ রাউন্ড গুলি এখনো উদ্ধার হয়নি। কারা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে ২ হাজার ২৪৭ জন বন্দী কারাগার থেকে পালিয়ে যায়। তাদের মধ্যে এখনো ৭৪০ জন পলাতক। এদের মধ্যে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, উগ্রবাদী মামলার আসামি, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ আসামি রয়েছে।
২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর খিলগাঁও থেকে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি)’ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন মো. ফয়জুর রহমান (৫৫)। প্রায় সাত মাস কারাগারে থাকার পর গত বছরের ৬ আগস্ট তিনি জামিনে মুক্তি পান। একইভাবে, নিষিদ্ধ সংগঠন ‘হিযবুত তাহ্রীর’-এর মতাদর্শে প্রচার চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার মো. আনোয়ার হোসেন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫ সেপ্টেম্বর জামিনে কারামুক্ত হন।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার অনেক আসামিই জামিন পেয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৪২৬ জন আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ১১৭ জন, ঢাকায় ১০১ জন, খুলনায় ৮১ জন, রংপুরে ৬৮ জন, রাজশাহীতে ৩৫ জন, ময়মনসিংহে ১৭ জন, সিলেটে ৬ জন এবং বরিশালে ১ জন। এর মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও রয়েছে।
তবে লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি কোথায় আছে, কারা ব্যবহার করছে, সে বিষয়ে এখনো স্পষ্ট তথ্য নেই। নির্বাচন সামনে রেখে এসব অস্ত্র অপরাধীদের হাতে থাকায় অস্বস্তিতে আছে সরকার। এজন্য লুট হওয়া অস্ত্রের তথ্য দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক শাহাদাত হোসাইন বলেন, ‘‘অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারে কাজ চলছে। পলাতক আসামিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে বাকিদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি ও বিশেষ অভিযান জোরদার করা হয়েছে।’’
তবুও পলাতক আসামিদের সক্রিয়তা আর লুট হওয়া অস্ত্রের খোঁজ না মেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলেও নিরাপত্তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। রাজনৈতিক মহলেও উদ্বেগ বাড়ছে। সরকারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘‘নির্বাচনের আগমুহূর্তে আগ্নেয়াস্ত্রের সরব উপস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। রাষ্ট্রীয় সংরক্ষণের অস্ত্র যদি অপরাধীদের হাতে যায়, তাহলে তা শুধু আইনশৃঙ্খলা নয়, গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি। দ্রুত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদার করা জরুরি। না হলে নির্বাচনী পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।’’

