দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসরে থাকা সাবেক উপ-পরিচালক মো. সামসুল আলমকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারীরা বলছেন, তিনি স্বাস্থ্য খাতের পরিচিত মাফিয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর ঘনিষ্ঠজন। সূত্রে দাবি, তার নামসহ পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের নামে রাজধানীতে বিশাল ভূমি-অবকাঠামো, ব্যবসা ও বিলাসবহুল বিনিয়োগ করা হয়েছে।
দুদক সূত্র ও আবহমান নথি থেকে দাবি করা হচ্ছে — মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর অনুকম্পায় এবং মিঠুর নির্দেশে সামসুল আলমসহ কয়েকজন দুদক কর্মকর্তার মাধ্যমে মিঠুর দুর্নীতির কাগজপত্র ঢেকে রাখা হতো। বিনিময়ে তারা কোটি কোটি টাকা গ্রহণ করেন। নথি নম্বর উল্লেখ করে অভিযোগ করা হয়েছে, পুরাতন ফাইল স্মারকে নতুন ফাইল তৈরি করে মিঠু ও তার স্ত্রীর শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, সামসুল আলম মিঠুর সঙ্গে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। অভিযোগ অনুযায়ী, দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন পাটোয়ারি (অর্থাৎ ইকবাল মাহমুদ) ওরফে কাজী শফিকুল আলম এবং বিশেষ স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুসন্ধান টিমের প্রধান সামসুল আলমই সিদ্ধান্ত নিতেন। তাদের নিয়োজনে কমিটির অন্য সদস্যরা — মামুনুর রশীদ চৌধুরী (এডি), মো. সাইদুর রহমান (ডিএডি), মো. ফেরদৌস হুমাম (ডিএডি), মো. জালাল উদ্দীন (ডিএডি) ও শাহজান মেরাজ (ডিএডি) — দুর্নীতি তদন্তের বদলে মিঠুকে রক্ষা করতেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিকাদারদের হয়রানি করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
দুদক নথি (বি: অনু: ও তদন্ত১/০৮-২০১৪, বি: অনু: ও তদন্ত-১/১২৫-১৫, দুদক/অনু: ১৪৭/ঢাকা/২০১৪, দুদক/বি: অনুঃ ও তদন্ত-১/৮৮-২০১৫, দুদক/বি: অনু: ও তদন্ত-১/১৪৫-২০১২ সহ) উদ্ধৃত করে বলা হয়, পুরাতন ফাইল স্মারকে নতুন ফাইল তৈরি করে মিঠু ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে থাকা বড় অঙ্কের দুর্নীতির মামলাসমূহ আপাততঃ বন্ধ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহের নামে ভুয়া ভাউচারে শত শত কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে অভিযোগ। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে — ৯৮১ স্মারকে ১০ কোটি টাকা ও ১৭২১ স্মারকে ৩ কোটি টাকা উত্তোলন। অভিযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও অন্যান্য কয়েকজন দালাল কর্মকর্তা মিঠুর সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন।
আর্থিক ও সম্পত্তির বিবরণ
দুদক সূত্র জানায়, সামসুল আলম ও তার পরিবারের নামে নিম্নলিখিত সম্পদ ও বিনিয়োগ রয়েছে —
- উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরে শশুরের নামে একটি ফ্ল্যাট, বাজারমূল্য প্রায় ২.৫ কোটি টাকা।
- একই এলাকায় শ্যালকের নামে আরেকটি ফ্ল্যাট, আনুমানিক ৩ কোটি টাকা।
- উত্তরা মাসকট প্লাজা নর্থ টাওয়ারে স্ত্রীর নামে একটি দোকান, আনুমানিক মূল্য ৮০ লাখ টাকা।
- ফায়দাবাদে ‘আশীর্বাদ নীড়’ নামে জমিসহ বাড়ি, আনুমানিক ২.৫ কোটি টাকা।
- কাট্টলী টেক্সটাইল লিমিটেডে শেয়ার — ২৭,৭,৩৬০ টাকার শেয়ার।
- স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিনের নামে দক্ষিণ খান ইউনিয়নে তিন তলার অর্ধেক মালিকানার ভবন, আনুমানিক মূল্য ১.২৫ কোটি টাকা।
- উত্তরার ফায়দাবাদে ১৮১.২ শতাংশ জমি, আনুমানিক মূল্য ৫৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। একই এলাকায় ৫.৫ শতাংশ জমি, বাজারমূল্য ২ কোটি ২০ লাখ টাকা।
- ফায়দাবাদ দারুল উলুম মাদ্রাসা রোডে ২টি টিনশেড এবং উত্তর খান ইউনিয়নে অন্য স্থাপনা; এসব থেকে বছরে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ভাড়া আযে।
- ব্যাংক ডিপিএস, এফডিআর ও সঞ্চয়ী হিসাব মিলে ওয়ান ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকে প্রায় ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা।
সূত্র আরো জানায়, স্ত্রী ও কন্যাদের বিদেশ সফরের খরচ মিঠু বহন করতেন। এতে রয়েছে ব্যাপক অর্থপাচারের অভিযোগ। কন্যাদের ভ্রমণ তালিকা উদ্ধৃত হয়ে বলা হয়েছে —
- কন্যা সুজানা সামরীন: ১৮ বার সিঙ্গাপুর, ৬ বার থাইল্যান্ড, এবং দুবাই, সৌদি আরব, ভারত, সিউল, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আমিরাতে একাধিকবার।
- কন্যা মার্শিয়া শারহিন রিনথি: ২২ বার সিঙ্গাপুর, ৯ বার থাইল্যান্ড, ৩ বার সুইডেন সহ অন্যান্য দেশে বারবার ভ্রমণ।
সুজানা সামরীনের বিয়ে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজন করা হয়। বিয়ের আয়োজন ও উপহার-প্রদান (কমপক্ষে ১৫০ ভরি স্বর্ণ) এবং তিন হাজার অতিথির আপ্যায়ন করা হয়েছিল। অভিযোগ, ভিড়েতেও দুদকের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না।
অভিযোগের পরিধি ও অর্থের পরিমাণ
সূত্রে বলা হয়েছে, দায়িত্বকালে সামসুল আলম স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ অনৈতিকভাবে অর্জন করেছেন। পাশাপাশি মিঠুর ব্যবসা ও বিদেশে প্রতিষ্ঠান গড়তে তার সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে। বনানীর আর্কেডিয়া নূর ক্যাসল নামে মিঠুর সিন্ডিকেটের আস্তানায়ও অভিযোগ অনুযায়ী তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং সেখানে নারী ও মদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন।
সংযুক্ত সূত্রগুলো দাবি করেছে, তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, পরিচালক কাজী শফিকুল আলম, উপ-পরিচালক মো. সামসুল আলম ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা উচিত। তাদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে অভিযোগকারীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেছেন, রিমান্ডে মিঠুর কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্নীতির বিষয়টি তদন্তের বাইরে নয় — অভিযোগ আছে এবং কর্তৃপক্ষ তা যাচাই করছে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাত দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে জর্জরিত। বড় ঠিকাদারি চক্র, সরকারি ক্রয়প্রক্ৰিয়া এবং কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ পড়ে আসছে। এই ধরনের অভিযোগ দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করে।

