চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা ইউনিয়নে এসএস পাওয়ার প্লান্টের জেটি ও আশপাশের এলাকায় এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাসুদের দীর্ঘমেয়াদি দখলের ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্থানীয়দের মতে, তিনি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে কুখ্যাত ছিলেন।
শুরুর দিকে কয়েকটি জমি বেশি দামে কিনে পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে হাজার হাজার একর সরকারি ও ব্যক্তিজমি দখল করে তিনি বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। বিশেষ করে সাগর ভরাটের মাধ্যমে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করা হয়। শত শত ড্রেজারের মাধ্যমে কয়েক কিলোমিটার সাগরপাড় ভরাট করে পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমে এই এলাকার মানুষ বর্ষা মৌসুমে মাছ এবং শুষ্ক মৌসুমে লবণ ও চিংড়ি চাষ করতেন। এখন এই সমস্ত জমি এস আলম গ্রুপের দখলে চলে গেছে।
স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সাইফুল ইসলামের নজর পড়ে গণ্ডামারার সাগরপাড়ের বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে। তিনি প্রথমে বেড়িবাঁধের পাড়ের ফসলি জমি বেশি দামে কিনতে থাকেন। স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসী নাসিরের মাধ্যমে তিনি ২০০ একরের বেশি জমি অধিগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে অস্থায়ী অফিস স্থাপন করে জোরপূর্বক জমি দখল শুরু হয়।
২০১৬ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু হয়। স্থানীয়দের প্রতিবাদকে দমন করতে দুই দফায় ভাড়াটে সন্ত্রাসী এবং পুলিশ ১১ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মামলা করলেও রাজনীতির প্রভাবে দীর্ঘ সময় তদন্ত আটকে থাকে। পরে সাইফুল ইসলাম সিঙ্গাপুরে পাসপোর্ট নিয়ে সপরিবারে চলে যান। কিন্তু বাঁশখালীর দখল আজও অক্ষত আছে।
বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবহার করে এই জমি দখল বৈধতার আড়াল পেয়েছে। চীনের সেফকো থ্রির সঙ্গে যৌথভাবে প্রথমে ৬০০ একর জমিতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা থাকলেও আজ প্রায় ১০ হাজার একরের জমি গ্রুপের দখলে। জেটি নির্মাণ করে কয়লা আনা হলেও মূলত সেগুলো ব্যবহার হয়েছে বেসরকারি বন্দর এবং ইকোনমিক জোন তৈরিতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, গণ্ডামারা ইউনিয়নে এসএস পাওয়ার প্লান্টের বিশাল চিমনি এবং জেটি এলাকার দৃশ্য অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। বাঁশখালী খালের ওপর ছোট ব্রিজ পার করলে চোখে পড়ে পরিত্যক্ত ফসলি জমি। এ জমিগুলো কংক্রিটের পিলার দিয়ে ঘেরা, ৬০৬ একর জায়গায় বিশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। জেটির ভেতরে নোঙর করা হয়েছে কয়েকটি বার্জ ও লাইটার জাহাজ। ২০২২ সালের শুরু থেকে দু’বছরে সাগর থেকে বালি তুলে কয়েক কিলোমিটার এলাকা ভরাট করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, আগে তারা বর্ষা মৌসুমে মাছ, শুষ্ক মৌসুমে লবণ ও চিংড়ি চাষ করতেন। হঠাৎ জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিজ নেওয়ার দাবি দেখিয়ে এস আলমের লোকেরা জমি ভরাট শুরু করে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও বাকিদের ওপর জোর করে দখল চালানো হয়।
এস আলমের প্রকল্পের বিরোধিতা করতে গিয়ে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল এবং ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল দুই দফায় গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালিয়ে ১১ জন নিহত হয়েছেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, বিদ্যুৎকেন্দ্রের আড়ালে গ্রুপটি বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল। সরকারি ও ব্যক্তিজমি জোরপূর্বক দখল করা হয়। নিহত পরিবারগুলো থেকে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ বা চাকরিও দেওয়া হয়নি।
পরিবেশকর্মীরা বলেন, বাঁশখালীর সৈকত ছিল কক্সবাজারের চেয়েও সুন্দর। লাল কাঁকড়া ও কচ্ছপের আবাস ছিল। ঝাউ ও বাইন বাগান বিস্তৃতভাবে ধ্বংস হয়েছে। সরকারি অনুমতি ছাড়াই সাগর ভরাট করা হয়েছে।
প্রশাসন জানায়, ঘটনার সময় রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে মামলাগুলো প্রভাবিত হয়েছিল। বর্তমানে সিআইডির বিশেষ টিম তদন্ত করছে। বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর নতুন কোনো জমি দখলের ঘটনা ঘটেনি। অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এস আলম গ্রুপের অফিসে দায়িত্বশীল কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সাইট প্রজেক্ট ম্যানেজার ফাইজুর রহমান বলেন, প্লান্টের জমি সংরক্ষিত, বাইরের জমিতে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

