বান্দরবানের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলার মধ্য দিয়ে মহেশখালী চ্যানেলে গিয়ে মিশেছে বাঁকখালী নদী। প্রায় ৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী একসময় ছিল যোগাযোগ, মৎস্যসম্পদ ও পরিবেশের অন্যতম ভরসা। কিন্তু বছরের পর বছর বর্জ্য ফেলার কারণে নদীটি এখন মারাত্মক সংকটে।
একসময় এ নদীতে মহাশোল, চিংড়ি, টেংরা, ইলিশ ও বিরল প্রজাতির লাল কাঁকড়াসহ নানা মাছ পাওয়া যেত। এখন সেসব প্রায় নেই। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, অন্তত ৫৭ প্রজাতির মাছ নদী ও মোহনা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
হাইকোর্ট এক দশক আগে নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধে নির্দেশ দিয়েছিল। সম্প্রতি আদালত আবারও আরএস জরিপের ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ, নদী সংরক্ষণ এবং ছয় মাসের মধ্যে এটিকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে দখলদার উচ্ছেদের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, বাঁকখালী একসময় ঝড়-ঝঞ্ঝায় নৌযানের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। এর দুই পাড়ের প্যারাবন জনবসতিকে রক্ষা করত। এখন সেখানে পৌরসভার ময়লার স্তূপে তৈরি হয়েছে ৫০ ফুট উঁচু আবর্জনার পাহাড়। দুর্গন্ধে শহরের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, “কক্সবাজার পর্যটন শহর হলেও ময়লার দুর্গন্ধে এখানে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়েছে।”
কলেজছাত্র সাইফুল বলেন, “দীর্ঘদিন কর্মসূচি করেও সমাধান পাইনি। পৌরসভা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।”
পরিবেশবাদীদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন কক্সবাজার শহরে ৯৭ টনের বেশি বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ৭০ টন সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। বাকিটা যাচ্ছে সাগরে। অথচ হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে পৌরসভা এখনও আবর্জনা নদীতেই ফেলছে।
পরিবেশ সংগঠন ‘ধরা’–এর সদস্য সচিব এইচএম ফরিদুল আলম শাহীন বলেন, “নদীর তীরে ৪৫-৫০ ফুট উঁচু ময়লার পাহাড় তৈরি হয়েছে। পৌরসভা আদালতের নির্দেশ মানছে না। শহরে ময়লা ফেলার কোনো নির্ধারিত স্থান নেই।”
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, নদীতে জমা বর্জ্য থেকে আর্সেনিক, কোবাল্ট, দস্তার মতো ক্ষতিকর পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে। এতে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। নদীর প্যারাবন ও বিরল গাছপালা ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা বলেন, “ভেটকি, গলদা, বাগদাসহ অনেক মাছ কমে গেছে। খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে যাচ্ছে। দূষণ রোধ, ড্রেজিং এবং অতিরিক্ত মাছ আহরণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।”
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বাসাবাড়ির পাশাপাশি শত শত হোটেল-মোটেল ও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বর্জ্যও সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। সেখান থেকে সেই দূষিত পানি গড়িয়ে যাচ্ছে সাগরে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য।
বাসিন্দা আদনান সাউদ বলেন, “পৌরসভা ডাম্পিং স্টেশনের জন্য জমি নিলেও তা বছরের পর বছর বাস্তবায়ন করেনি। এখনই ময়লার পাহাড় সরাতে হবে।”
এ বিষয়ে পৌরসভার প্রশাসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ডাম্পিং স্টেশন তৈরির প্রস্তুতি চলছে। জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে নানা কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।” (সূত্র : বণিক বার্তা)

